গাজার হাসপাতালে হামলার যা জানা গেছে, এখনো যা অজানা

গত মঙ্গলবার রাতের বিস্ফোরণের পর আল-আহলি হাসপাতাল প্রাঙ্গণের একাংশ। ছবি : গেটি ইমেজ

গাজা সিটির জনবহুল আল-আহলি হাসপাতালে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন সে সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাথমিকভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এতে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। এ ঘটনার পর গাজায় হামাস নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলকে দোষারোপ করে দাবি করেছে- এটি একটি ইচ্ছাকৃত বিমান হামলা। ইসরায়েল এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

দুই পক্ষের এমন দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যে প্রকৃত সত্য জানাটা বেশ কঠিন। এমন অবস্থায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম বিবিসির ভেরিফাই টিম ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণসহ অন্যান্য প্রমাণ দেখে ঘটনাটির কী জানা গেছে এবং কী জানা যায়নি তা উন্মোচনের চেষ্টা করছে। প্রকৃত অবস্থা দেখতে বিবিসির এক সাংবাদিকও ঘটনাস্থলে গেছেন। যদিও সেখানে তাঁর প্রবেশাধিকার সীমিত।

বিবিসি আরো বলছে, অস্ত্রের লড়াইয়ের পাশাপাশি এই সংঘাত একটি ‘তথ্য যুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে ওই হাসপাতালে বিস্ফোরণটি ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও থেকে বিস্ফোরণটি সম্পর্কে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই ভিডিওতে ধেয়ে আসা একটি প্রজেক্টাইলের (এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র) সতর্কসংকেত শোনা যায়।

এরপর এটি বিস্ফোরণ হলে আগুনের বিশাল কুণ্ডলী দেখা যায়।

গাজার স্থানীয় সময় রাত ৬টা ৫৯ মিনিটে আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের লাইভ ফুটেজে গাজার আকাশে একটি উজ্জ্বল আলো উঠতে দেখা যায়। এটি দিক পরিবর্তনের আগে দুইবার জ্বলে ওঠে ও পরে বিস্ফোরিত হয়। এরপর অনেক দূরে মাটিতে একটি বিস্ফোরণ দেখা যায়। অনেকে বলেছেন, ওই আলো একটি রকেট থেকে এসেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন ফুটেজে একই বিস্ফোরণ দেখা গেছে।

বিবিসি বলছে, তারা অস্ত্র বিশেষজ্ঞ কম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্তত ২০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের মধ্যে ৯ জন বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় (বাংলাদেশ সময়) এ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া জানাননি। পাঁচজন মন্তব্য করবেন না। বাকি ছয়জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, নিশ্চিত হওয়া কঠিন হলেও প্রাথমিক প্রমাণ দেখে মনে হচ্ছে, একটি ব্যর্থ রকেট গাড়ি পার্কিংয়ে আঘাত করে এবং এ থেকে পরে আগুন ধরে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জে আন্দ্রেস গ্যানন বলেন, তিনি যে ফুটেজ দেখেছেন তা থেকে প্রজেক্টাইলটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে কি না তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আকাশে দেখা যাওয়া ঝলকানিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছিল একটি রকেট। যেটি অতিরিক্ত গরম হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।

ঝুঁকি মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান সিবিলাইনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রধান বিশ্লেষক ভ্যালেরিয়া স্কুটো বলেন, অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া ফুটেজে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আগুন দেখা গেছে। তবে সেটি ক্ষেপণাস্ত্র থেকে সৃষ্ট কি না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বিস্ফোরণস্থলের চিত্র
বিবিসি আল-আহলি হাসপাতাল ভবনের বিশদ বিবরণ এবং কিছু স্যাটেলাইট ইমেজ সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখেছে। এ থেকে হাসপাতালে বিস্ফোরণের স্থানটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণটি হাসপাতালের একটি উঠানে ঘটেছে। বিস্ফোরণস্থলের মাটির চিত্রের মতো ক্ষয়ক্ষতি আশপাশের ভবনগুলোতে তেমন দেখা যায়নি। ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, পোড়া দাগ এবং পুড়ে যাওয়া গাড়ি।

হাসপাতালটি একটি চার্চের মালিকানাধীন। জেরুজালেমের সেন্ট জর্জ কলেজের ডিন ক্যানন রিচার্ড সিওয়েল বিবিসিকে বলেন, বিস্ফোরণের সময় প্রায় এক হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং প্রায় ৬০০ রোগী ও কর্মী ভবনের ভেতরে ছিলেন।

আল-আহলি হাসপাতালে গেছেন বিবিসির প্রতিবেদক রুশদি আবু আলুফ। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁকে ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্যের কথা বলেছেন। আরো জানিয়েছেন, মৃতদেহগুলো এখনো সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক ব্যক্তি তাঁকে বলেছেন, বিস্ফোরণের সময় নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা হাসপাতালে ছিলেন।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ৪৭১ জন নিহত হয়েছেন। আর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, এই সংখ্যাটি ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছে। তবে কতজন মারা গেছে সে সম্পর্কে তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন প্রকাশ করা হয়নি। 

যা জানা যায়নি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণগুলোর মধ্যে একটি হলো বিস্ফোরণের ফলে তৈরি হওয়া গর্তের ধরন। আইডিএফ বলছে, বিস্ফোরণটি তাদের অস্ত্র দ্বারা হয়নি। ঘটনাস্থলে বড় গর্ত না থাকা, আশপাশের ভবনগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি এটি প্রমাণ করে। 

অনুপস্থিত প্রমাণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো। প্রজেক্টাইল সাধারণত শেলের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হাসপাতালটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে হামাসের দুই সদস্যের কথোপকথনের একটি অডিও প্রকাশ করেছে আইডিএফ। তবে স্বাধীনভাবে ওই অডিও যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এক বিবৃতিতে পিআইজে এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে এবং বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।

LEAVE A REPLY