দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন: তেল চিটচিটে অস্বস্তির গল্প

ঘটনা ২০১৫ সালের। শুভ লগ্ন দেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন দক্ষিণ ভারতের একটি এলাকার বাসিন্দা জিও বেবি। তিনি আবার লিঙ্গীয় সমতায় বিশ্বাসী। তাই বিয়ের পরদিন থেকেই স্ত্রীর পাশাপাশি রান্নাঘরের দায়িত্ব নিলেন।

এর কয়েক দিন পরই তাঁর মনে হলো―এই আদা, রসুন, হলুদ, লঙ্কা, তেল, পানির ট্যাপ, শিল-পাটা আর চুলার আগুনের ক্রমাগত ওঠানামা তাঁর মনোজগতে অস্বস্তিকর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। পুরো রান্নাঘর তাঁর কাছে কারাগারের মতো মনে হতো লাগল। একসময় উপলব্ধি করলেন, এ থেকে তাঁর আর বের হওয়ার রাস্তা নেই। 

নিজের জীবনের এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রের পরিচালক জিও বেবি সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন।

নাম ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’। ২০২১ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি বেশ ভালোভাবেই নাড়া দেয় দর্শকের। পরিবারের সদস্যদের জন্য তিন বেলা খাবার রান্না, থালা-বাসন মাজতে মাজতে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেওয়া এবং রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কেবল স্বামীর ইচ্ছা পূরণে সহবাস করা একজন নারীর মনোজগৎ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটিই উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। 

পারিবারিক আয়োজনে এক নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষকের বিয়ের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সিনেমাটি শুরু হয়।

শুরুটা অন্য আর দশটা সিনেমার মতো হলেও পরের দৃশ্যে আমরা যা দেখতে পাই, সেগুলোকেও যে সিনেমার পর্দায় আনা যায়―পরিচালকের সে ভাবনা প্রশংসার দাবি রাখে। এসব দৃশ্যে আমরা প্রচলিত সিনেমার বয়ান দেখতে পাই না। দেখতে পাই, আমাদের আশপাশে ঘটা প্রতিদিনকার ঘটনা। বিশেষ করে রান্নাঘরে দিন কাটিয়ে দেওয়া এক নারীর কর্মযজ্ঞ। এটি এমন এক গল্প যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেনি কিংবা দেখতেই চায়নি।

সিনেমার প্রধান চরিত্রকে আমরা ভারতীয় নারীদের হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিনিধি হিসেবে আবিষ্কার করি। যিনি দিনের পর দিন রান্নাঘরকে কেন্দ্র করে লড়াই করে যাচ্ছেন। লড়াই করে যাচ্ছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাবার তৈরির মানসিকতার সঙ্গে, পুরুষের খাবারের চাহিদা এবং যৌন রুচির বৈচিত্র্যের সঙ্গে। তাকে লড়াই করতে হচ্ছে পানি সরবরাহের পাইপের ছিদ্রের সঙ্গে, বাসি আর তেল চিটচিটে থালাবাটির সঙ্গে। এই লড়াইয়ে নারীর কোনো স্বীকৃতি নেই বরং পিছিয়ে পরা মাত্রই পুরুষের ‘অহং’ তাকে নানাভাবে চোখ-রাঙায়, শাসন করে। এ ক্ষেত্রে সিনেমার প্রধান নারী চরিত্রের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের অন্দরমহলের সহিংস প্রকাশভঙ্গি স্পষ্ট করে। 

দিন শেষে এটি একটি অস্বস্তিকর সিনেমা, যদি আপনি পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিতে দেখেন। এর বাইরে কলাকুশলীদের সহজাত অভিনয়, আবহসংগীতে পরিমিতিবোধ, লোকেশন, সেটের সাধারণ উপস্থাপন চোখকে আরাম দেয়। এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের সিনেমাটি ২০২৩ সালে তামিল ভাষায় রিকেম হয়েছে। ঘোষণা এসেছে বলিউডেও রিমেক হবে।

LEAVE A REPLY