সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বর মাসের যেকোনো সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করবে সরকার। এ নিয়ে ছয় মাস ধরে কাজ করছে মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে সরকার গঠিত কমিটি। তবে এই বেতন বৃদ্ধির বর্ধিত খরচ মেটাতে বিদেশি ক্রেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন গার্মেন্টস মালিকরা।
এ জন্য রপ্তানি করা প্রতিটি পোশাকে দুই সেন্ট হিসাবে বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে বছরে অন্তত এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়তি আদায়ের চেষ্টা করছে বিজিএমইএ।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় খরচ মেটাতে বিজিএমইএর এই চেষ্টা। একই সঙ্গে বাড়তি দাম চেয়ে বায়ারদের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে গার্মেন্টস মালিকদের।
ব্র্যান্ড-রিটেইলার এবং বায়ার প্রতিনিধিদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি অবহিত করার পাশাপাশি রপ্তানি করা পোশাকের দাম বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। অবশ্য বিজিএমইএ সদস্য গার্মেন্টস মালিকদের কাছে দেওয়া অন্য এক চিঠিতে প্রতিটি পোশাকে অন্তত দুই সেন্ট করে বাড়াতে বায়ারদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু বেতন বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া চলছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। বায়ার বর্তমানে যে প্রাইস দিচ্ছে সেটা দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারছি না। সে জন্য বায়ারদের চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি যেন প্রতি পিস অর্ডারে কমপক্ষে দুই সেন্ট বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
তাহলে এটা হবে আমাদের ব্রেকইভেন কস্ট। এতে কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব।’
গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের দাবি, বছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হলেও এর মধ্যে ৮০ শতাংশ হিসাবে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যাক টু ব্যাক কাঁচামাল আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে হয়। বাকি ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন হিসেবে খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলের পাশাপাশি কারখানা ভাড়া।
আর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বরেই বাড়ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন।
সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০০ মার্কিন ডলার হিসাবে আট হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এবার শ্রমিকরা ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা দাবি করছেন। তবে সংকট মোকাবেলায় পোশাকপ্রতি দুই সেন্ট বাড়তি আদায়ের কোনো বিকল্প দেখছেন না গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার কমে যাওয়ায় তৈরি পোশাক খাত নানামুখী সংকটের মধ্যে রয়েছে।
কারণ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘এবার একটু বেশি শঙ্কিত। কারণ বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে যেভাবে মূল্য এবং চাহিদা কমেছে, সে সময়টাতে শ্রমিকদের মিনিমাম ওয়েজ বৃদ্ধি পাবে। সব মিলিয়ে এবারের পরিস্থিতিটা কিছুটা ভিন্ন। সে কারণে বিজিএমইএর কাছ থেকে বায়ারদের কাছে যে আবেদন করা হয়েছে সেই প্রতি পিসে দুই সেন্ট বাড়ানো হলে আমরা কিছুটা সমন্বয় করতে পারব।’
‘আমরা ব্যবসায়ীরাও ব্যক্তিগতভাবে বায়ারদের সঙ্গে কথা বলছি। তারাও বিভিন্নভাবে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বলছে। পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি তারাও সেখানে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা চেষ্টা করব বায়ারদের কনভিন্স করার জন্য।’
তবে চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, চলমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বাড়লে মালিকপক্ষের জন্য তা হবে সহনীয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১১০ টাকা হয়েছে। এ সময় টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। দ্রব্যমূল্যের স্ফীতি ১০ শতাংশ ধরলে বেতন বৃদ্ধি ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়।’
কিন্তু এর পরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেশের অন্যতম বৃহৎ প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘প্রতি পাঁচ বছর পর পর শ্রমিকদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এবার বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা বিবেচনায় এটা সামাল দেওয়া একটু কঠিন হবে। গার্মেন্টসে অর্ডার কম, বিশ্বমন্দার কারণে কাস্টমারদের বিক্রিতেও প্রভাব পড়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রডাক্টের দাম বাড়ানোর জন্য বলে এলেও ক্রেতারা নানা অজুহাতে উল্টো দাম কম দেওয়ার চেষ্টা করে।’
এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। গত ১০ বছরে আমাদের রপ্তানি যে হারে বেড়েছে, সে হারে কর্মসংস্থান বাড়েনি। তার মানে আমাদের শ্রমিকরা এখন আগের চেয়ে দক্ষ।’
সাধারণত বাইরের কর্মীদের চেয়ে ইপিজেডের শ্রমিকরা একটু বেশি বেতন পান। এখানে গার্মেন্টস শ্রমিক ছাড়াও হালকা ও ভারী শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়।
আদমজী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরই মধ্যে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক চলছে। আমাদের প্রতিনিধিরা মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ করছে। বেপজার বাইরে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা এলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের ঘোষণাও চলে আসবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া আছে। ইপিজেড অভ্যন্তরের শ্রমিকদেরও সেভাবেই আশ্বস্ত করা হয়েছে।’