ভৈরবে প্রাণ গেল ২০ যাত্রীর

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রীবাহী ট্রেনে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় অন্তত ২০ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের চারটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে খাদে পড়ে যায়। সোমবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, আর যাত্রীবাহী আন্তঃনগর এগারসিন্ধুর গোধূলি যাচ্ছিল ভৈরব থেকে ঢাকার দিকে। 

এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দায়ী প্রমাণিত হওয়ায় মালবাহী ট্রেনের চালক ও গার্ডকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, কন্ট্রোলরুমের ভুলের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পর দুটি ট্রেনের চালক, স্টেশন মাস্টার, কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা উধাও হয়ে যান। এদিকে এ দুর্ঘটনার ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও নোয়াখালীর সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১১টার দিকে এ রুটে আংশিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। 

ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ চার বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। দুর্ঘটনার পর এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আহত ও আতঙ্কিত যাত্রীদের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে চার পাশ। অক্ষত বগিগুলো থেকে যাত্রীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়েন। দ্রুত বের হতে গিয়ে অনেক যাত্রী তাদের স্বজনকে হারিয়ে ফেলেন। 

আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন দুর্ঘটনাস্থলে। এগারসিন্ধুর গোধূলি ট্রেনের অনেক যাত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের জেলার। দুর্ঘটনার পর আশুগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে তাদের স্বজনদের খোঁজে আসেন। এ সময় স্বজনদের চিৎকার-আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। পরে একে একে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও বিজিবির সদস্যরা এসে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। 

সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেনের কয়েকটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে একদিকে হেলে পড়েছে। বগির ভেতরে যাত্রীদের আসনও ভেঙে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হতাহত যাত্রীদের ব্যাগসহ নানা সরঞ্জাম। এখানে ওখানে রক্তের দাগ লেগে আছে। বগির নিচেও অনেক যাত্রী চাপা পড়েন। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকে আতঙ্কিত হয়ে কাঁদছিলেন। 

ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্বর্ণা বেগম যুগান্তরকে বলেন, আমি কিশোরগঞ্জ থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে উঠি। ভৈরব রেলস্টেশনে পৌঁছি দুপুর ২.৪০ মিনিটে। এরপর ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে বিকাল ৩.১২ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। এর তিন মিনিট পর হঠাৎ বিকট শব্দে ঝাঁকুনি দিতে দিতে ট্রেনটি থেমে যায়। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমিও সিট থেকে পড়ে যাই। এরপর যাত্রীদের চিৎকার-কান্না শুরু হয়। 

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পেছনের কয়েকটি বগি কাত হয়ে পড়ে গেছে। পরে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। 
ট্রেনের আরেক যাত্রী মোশারফ হোসেন বলেন, কনটেইনার ট্রেনটির গতি ছিল অনেক বেশি এবং এগারসিন্ধুর গতি ছিল কম। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে এগারসিন্ধুর ট্রেনের পেছনের চারটি বগি চুরমার হয়ে যায়। বগিগুলো উলটে খাদে পড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক বগিতে ৭০-৮০ জন করে যাত্রী ছিলেন। এ সময় বগির যাত্রীদের অনেকে চাকার নিচে পড়ে হতাহত হন। 

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাদিকুর রহমান সবুজ, থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম, ভৈরব রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ আলিম সিকদারসহ র‌্যাব, পুলিশ, ফায়ার সর্ভিস, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নেন ও তদারকি করেন। রাতে ঢাকা থেকে আসে রিলিফ ট্রেন। এদিকে ঘটনাস্থলে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যার পর উদ্ধার কাজে বেগ পেতে হয়। হাতে ব্যবহৃত লাইট ও মোবাইলের আলোয় উদ্ধারকর্মীদের কাজ করতে দেখা গেছে। রাত পৌনে ১১টায় একটি লাইন দিয়ে আংশিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ছেড়ে যায় মালবাহী ট্রেনটিও। তবে যে লাইনে দুর্ঘটনা ঘটে সেই লাইনে চলাচল বন্ধ ছিল।  

ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সুত্র জানায়, রাত ৮টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনজন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৯ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-ময়মনসিংহের নান্দাইলের জোছনা বেগম ও সুজন মিয়া, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের হুমায়ূন, বাজিতপুরের আদির উদ্দিন, ভৈরবের আফজাল, সুজন শীল ও রাব্বি, কিশোরগঞ্জের সায়মন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের নিজাম উদ্দিন সরকার। রাত ৯টায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

আহতদের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা জানান, এই হাসপাতালে ৭০ জন আহত যাত্রীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। 

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, খবর পেয়ে আমি দ্রুত ভৈরব চলে আসি। এখানে এসে উদ্ধার কাজ পরিচালনাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করি। দুর্ঘটনা কিভাবে হলো তা জানতে রেলস্টেশনের কাউকে খুঁজে পাইনি। এমনকি ট্রেনের দুই চালককেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান জানান, রেলস্টেশনের কন্ট্রোলরুমের ভুলের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি। কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। খবর পেয়ে আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ তদারকিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করি। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

দুটি তদন্ত কমিটি গঠন : রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় প্রাথমিকভাবে মালবাহী ট্রেন দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। মালবাহী ট্রেনের চালক-গার্ড সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেনটি চালাচ্ছিল। ইতোমধ্যে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে একটি বিভাগীয় এবং জোনাল পর্যায়ে মোট ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ : ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে অনেক ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়। বিভিন্ন স্টেশনে নানা গন্তব্যের যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরে গেছেন। কেউ কেউ বিকল্প পথে গন্তব্যে যান। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আফছার উদ্দিন জানান, উদ্ধার কাজের জন্য রিলিফ ট্রেন পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর আখাউড়া জংশন থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুদিকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী, মহানগর গোধূলী, কালনী এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, সোনারবাংলা ট্রেন আটকে পড়েছে।

আহত ৬ জন ঢাকা মেডিকেলে : আহতদের মধ্যে ৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই শিশুসহ ৫ জন একই পরিবারের। আহতরা হলেন-জীবন মিয়া (৪০), তার স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩৫), মেয়ে তন্নিমা (১৫), দুই ছেলে জিয়াদ (১০) ও সোয়াদ (৮) এবং ভাঙারি ব্যবসায়ী আবুল কাশেম মিয়া (৫৫)। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তাদের ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তাদের অবস্থা গুরুতর নয়। আহত জীবন মিয়া জানান, তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদরে। তার স্ত্রী খাদিজা নারায়ণগঞ্জ ভুলতা গাউছিয়ায় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। সেখানেই থাকেন তারা। স্ত্রীর এক ভাই বিদেশ থেকে দেশে আসায় তার সঙ্গে দেখা করতে পাঁচদিন আগে শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলেন তারা। 

ঢাকার চার হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ : হতাহতদের জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিতে রাজধানীর চার হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হাসপাতালগুলো হলো-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল ও আগারগাঁওয়ে নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট। আগত রোগীকে জরুরিভাবে সেবা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সোমবার রাতে জরুরি এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্ত?রের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান।

LEAVE A REPLY