আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামছে হেফাজতে ইসলাম। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরা বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামছে। যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে মাঠে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন।
এদিকে হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য সমমনা ইসলামী দল এবং বির্তকিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোরও মাঠে নামার কথা রয়েছে। একই দিন আওয়ামী লীগও শান্তি সমাবেশ করতে মাঠে থাকছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশেই টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এমনকি বড় ধরনের নাশতকার আশঙ্কাও রয়েছে বলে উচ্চ পর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। সূত্র বলছে, সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়া পল্টনে মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। এরই মধ্যে জামায়াতও শাপলা চত্বরে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। একই দিন আওয়ামী লীগও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। তিনটি বড় রাজনৈতিক দলের এমন কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিশে মাঠে নামছে হেফাজতে ইসলাম। দলের নির্দেশনা মোতাবেক নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে ব্যানার নিয়ে মাঠে না নামার কথা রয়েছে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা মোতাবেক নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে ব্যানার নিয়ে নামার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। তবে সবই নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। আপাতত হেফাজতে শীর্ষ নেতারা মাঠে থাকছেন না এটা নিশ্চিত। তারা দূর থেকে পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে তাদেরও প্রকাশ্যে নেমে পড়ার কথা রয়েছে। দায়িত্বশীল একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা নিজেদের মধ্যে কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পরে দলটি সমমনা অন্যান্য ইসলামী দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপাতত তারা বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়েই মাঠে নামছেন। সুযোগ হলে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কথা রয়েছে।
দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালনের অনুমতি নিয়ে শাপলা চত্বরে বসে পড়েন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। তাদের তুলতে গেলে দলটির নেতাকর্মীরা মতিঝিল, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, তার সামনের অন্তত হাজারখানেক দোকানপাট, ৬ শতাধিক পবিত্র কোরআন শরীফ, বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দেয়। দুই শতাধিক যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সাংবাদিক, পুলিশ, পথচারীসহ অন্তত ২০০ জনকে আহত করে। শতাধিক ভবন ভাঙচুর করে তারা। অন্তত হাজারখানেক দরিদ্র হকারদের দোকান পুড়িয়ে দেয়। সেদিন পুরো এলাকা পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। রাত আড়াইটা পর্যন্ত মতিঝিলে অবস্থান করে ১৩ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত শাপলা চত্বর না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই ঘটনায় হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে জানান, পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে বিএনপি জড়িত। এমনকি বিএনপির কোনো নেতার কি দায়িত্ব পালনের কথা ছিল তাও ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল হেফাজত ও বিএনপির হাইকমান্ড থেকে। বিএনপির সরাসরি মদতে হেফাজত ওইদিন বসে পড়েছিল।
দায়িত্বশীল ওই গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র আরও বলছে, ওই দিন বিএনপির সহযোগিতা ও মদত দেওয়ার প্রতিদান দিতে চায় হেফাজতে ইসলাম। তারই ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলাম সর্বশক্তি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামছে। দলটির নেতাকর্মীদের দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের অনিবন্ধিত দল হওয়ায় মতিঝিলে সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। এজন্য দলটির নেতাকর্মীদের হেফাজতের সঙ্গে একত্রে বিএনপির সমাবেশে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্রটি বলছে, বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের জেলা পর্যায় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে। দেশের অধিকাংশ থানায়ও কমিটি আছে। তবে আংশিক। থানা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই অনান্য ইসলামী দলেরও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইসলামী দলগুলোর আড়ালে বির্তকিত ও নিষিদ্ধ দলগুলোর নেতাকর্মীরা বিএনপির সমাবেশকে পুঁজি করে বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটাতে পারে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলছেন, আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির ডাকা কর্মসূচির আড়ালে নাশকতার চেষ্টা করা হলে, তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। ঢাকার প্রায় সোয়া ২ কোটি বাসিন্দার জানমালের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস করা হবে না। সমাবেশ ঘিরে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এতে দেশবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান থাকবে।
উচ্চপর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে মৌলভীবাজার জেলায় হেফাজতে ইসলামের মূল গোড়াপত্তন হয়। জেলাটির বালিয়াকান্দি গ্রামের হজরত শায়খ বর্ণভী (রহ.)-এর হাত ধরে হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। তখন হেফাজতে ইসলামের নাম ছিল ‘দ্বীনি জামাতে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম’। পাকিস্তানেও দীর্ঘদিন ধরে এমনই একটি সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এজন্য পরবর্তী সময়ে দলটির নাম সংক্ষিপ্ত করে ‘হেফাজতে ইসলাম’ করা হয়। ১৯৫৪ সালে সিলেটের বন্দরবাজার জামে মসজিদে উলামা মাখায়েশদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলামের সৃষ্টি হয়। সংগঠনটির প্রথম আমির ছিলেন হজরত শায়খ বর্ণভী (রহ.)।
দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থার একটি শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, হজরত শায়খ বর্ণভী (রহ.)-এর অবর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুস উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফিকে (প্রয়াত) হেফাজতে ইসলামের আমির করা হয়। ২০১০ সালে নারীনীতি ও ফতোয়া সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের রায় বাতিলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সংগঠনটি জোরালোভাবে মাঠে নামে।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ব্লগার ও অনলাইন এশটিভিস্টদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হওয়ার পরে সরব হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। বর্তমানে কিছুটা রাজনৈতিক ঘরনায় দলটি পরিচালিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। যদিও হেফাজতে ইসলাম সব সময়ই দাবি করে আসছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কার্যক্রম চলে আসছে।