নিজ স্বার্থে প্রতিবেশীর বিপদে চুপ আরবরা

গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লংঘন করছে ইসরাইল। নির্বিচারে হত্যা করছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। বেসামরিক হত্যা আর বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে বিশ্বের জায়গায় জায়গায় হচ্ছে বিক্ষোভ। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রেও প্রতিদিন বিক্ষোভ করছে লাখ লাখ মানুষ। অথচ আরব বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের রাষ্ট্র সৌদি আরবের মতো ফিলিস্তিনের বাকি প্রতিবেশীরাও কার্যত চুপচাপ বসে আছে। সকাল-দুপুর দু-চারটে নীতি বাক্য ছাড়া বড় কোনো উদ্যোগই নেই আরব বিশ্বের। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র করেছে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলকে সুরক্ষায়।

৭ অক্টোবর হামাসের অভিযানের পরপরই রণতরী পাঠিয়েছে ভূমধ্যসাগরে। খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ একের পর এক মন্ত্রী, জেনারেল ছুটে এসেছেন ইসরাইলে। এসেছে পশ্চিমা মিত্ররাও। উলটো দিকে ইরান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকেই গাজা রক্ষায় এমন বুকচিতিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেনি বিশ্ব। ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের মতো মারমুখী সমর্থন দূরের কথা, দ্রুত যুদ্ধবিরতির দাবিতে কোনো শক্ত প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারেনি মুসলিম বিশ্বের ২২ জাতির আরব লীগ অথবা ৫৭ রাষ্ট্রের অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনভুক্ত (ওআইসি) দেশগুলোও। মখমলের গদিতে বসে শুধু ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েই ক্ষান্ত আরব নেতারা। কিন্তু কেন এই নীরবতা? ধনে-জনে বড় হওয়া সত্ত্বেও কেন এই অনৈক্য? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব মানবতা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, আঞ্চলিক পিছুটান ভুলে কেবলমাত্র নিজ স্বার্থেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন আরব বিশ্বের নেতারা। 

পৃথিবীর সব অভিজাতের মতো আরব অভিজাতদেরও প্রথম নজর নিজ স্বার্থে। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে তেলের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ‘প্রেমিক’ হয়ে উঠেছে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো। বিশ্বস্ত সঙ্গীর মতো বিনাবাক্যে নিজেদের তেলনির্ভর অর্থনীতির চাকা ছেড়ে দিয়েছে পশ্চিমের হাতে। পশ্চিমা দেশগুলোতে তেল রপ্তানিই দেশগুলোর অন্যতম জীবিকা। হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোই এখন মধ্যপ্রাচ্যের ‘বড় কর্তা’। গাজা সমর্থনে যদি কর্তার মন বিগড়ে যায়, যদি অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন, যদি রাগে ক্ষোভে নিষেধাজ্ঞার শেকল পরিয়ে দেন পায়ে, তখন কোথায় বেচবে তাদের ‘তেল’? শিরা-ধমনীতে চেপে বসা এই ভয়ের স্রোতেই মানবতা ভেসে গেছে আরব নেতাদের। বিশ্লেষকদের এই যুক্তি সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে জর্ডানের কথায়। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, ইসরাইলের কর্মকাণ্ড আত্মরক্ষা নয় বরং ‘প্রকাশ্য আগ্রাসন’। ইসরাইলের পরিবর্তে অন্য দেশ থাকলে নিশ্চিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতো। কিন্তু আরব দেশগুলো তা করছে না। আর এর পেছনে বাস্তবতা হলো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হলে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক অনেক সুযোগ হাতছাড়া করবে আরব দেশগুলো। এছাড়া আগের যুদ্ধগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইসরাইলের সামরিক শক্তির কাছে পেরে উঠবে না আরবরা।

যুদ্ধের শুরুতে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো সংঘাত থেকে দূরে থাকবে- এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে ইরান নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল তারা। আর ইরানকে নিরস্ত্র করার অস্ত্র হিসাবেই পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলের প্রতিপক্ষ হামাসকে নয় বরং ইরানকে লক্ষ্য করেই এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের। এটা শক্তি প্রদর্শন বা ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যে ইরানের ওপর হামলা আর দেশটির পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আছে এ বিষয়ে ভালো করেই জানেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। আর সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না ইরান। এটাও বেশ ভালো করেই জানে ‘দুই মিত্র’।

তবে আরব বিশ্বের আগের চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় বিভিন্ন সংঘর্ষে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করেছিল সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও মিসরের আরব সেনারা। ১৯৭৯ সালে ইসরাইলের সঙ্গে প্রথম শান্তি স্থাপনকারী দেশ মিসর। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম  চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে একের পর এক মুসলিম দেশ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করে। আর তখন থেকে শুরু করে বর্তমানের নিত্যদিনের হত্যাকাণ্ডে চোখ বন্ধ করে রেখেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পশ্চিম এশিয়ার প্রধান দেশগুলো। 

LEAVE A REPLY