কপ প্রেসিডেন্টের মন্তব্য ঘিরে তোলপাড়

বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনার ঝড় তোলা দুবাই কপের প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবের পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞদের চাপের মুখে নিজের পক্ষ সমর্থন করলেন গতকাল সোমবার। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ভূমিকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে উপেক্ষা করার দায়ে অভিযুক্ত আল জাবের গতকাল বলেন, ‘আমরা বিজ্ঞানকে সম্মান করি, ব্যাপক আস্থাও রাখি।’

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজন নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কিছু নথি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

নথিগুলোতে ইঙ্গিত ছিল, দুবাইয়ে কপ সম্মেলন আয়োজনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমিরাত তেল-গ্যাস বিক্রির অনেক চুক্তি করার পরিকল্পনা করছে।

কপ-২৮-এর প্রেসিডেন্ট সুলতান আল জাবেরকে নিয়েও ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। কারণ জাবের নিজেই আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কম্পানির (অ্যাডনক) প্রধান। জাবেরের এক মন্তব্য এরই মধ্যে তাঁকে ঘিরে থাকা বিতর্ক নতুন করে উসকে দিয়েছে।

গত ২১ নভেম্বর জলবায়ুবিষয়ক এক অনলাইন অনুষ্ঠানে জাবের বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি বেশির মধ্যে সীমিত রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে, এ কথা কোনো বিজ্ঞান বলে না।’

খানিকটা পুরনো এই মন্তব্যই রবিবার জলবায়ু সম্মেলনে নতুন করে চাউর হয়; এর পরই শুরু হয় তোলপাড়।

বিজ্ঞান কী বলে

বিশ্বজুড়ে এখন যত গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ঘটে তার ৮০ শতাংশই হয় তেল-গ্যাস নিয়ে কাজ করা জ্বালানি, শিল্প, পরিবহন ও নির্মাণ খাত থেকে। জলবায়ুবিষয়ক আন্ত সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকতে বিশ্বকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৯ শতাংশ কমাতে হবে।

সুলতান জাবের আরো বলেছিলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে দিলে মানবজাতি আদিমকালের গুহায় ফিরে যাবে। আইপিসিসির প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছে, ব্যাপারটি সে রকম হবে না। কারণ এখনই আমাদের হাতে দূষণমুক্ত অত্যাধুনিক প্রযুুক্তি রয়েছে।

আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোট গ্রিন হাউস গ্যাসও ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ, ২০৪০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৯ শতাংশ কমিয়ে আনতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সমালোচনার জবাবে গতকাল সুলতান আল জাবের বলেন, ‘আমরা বিজ্ঞানকে সম্মান করি, এর ওপর ব্যাপক আস্থাও রাখি।

…বিজ্ঞান বিষয়ে আমার অবস্থান স্পষ্ট করি। কিছু বিভ্রান্তি ও ভুল উপস্থাপন হয়েছে বলে মনে করছি আমি। আমি প্রকৌশলবিদ্যা পড়েছি।…আমি যা করি, তা বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রেখেই করি।’

বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া

রবিবার কপ-২৮-এর স্বাস্থ্য দিবসে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ল্যানসেট কাউন্টডাউনের প্রধান নির্বাহী মারিন রোমানেলো বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব বিষয়ে সব বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও সতর্কতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত ছাড়া যে সিদ্ধান্তই আসবে, তা হবে ব্যর্থ সিদ্ধান্ত।’

গ্র্যান্থাম ইনস্টিটিউটের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের গবেষণা পরিচালক ও ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ুবিজ্ঞান ও নীতির অধ্যাপক জোয়েরি রোগেলি বলেছেন, ‘আমি কপের প্রেসিডেন্টকে আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনটি পড়তে বলব। আরব আমিরাতসহ ১৯৫টি দেশ সর্বসম্মতভাবে এই প্রতিবেদনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’

জাবেরের মন্তব্য উদ্বিগ্ন করেছে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদেরও। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ‘আইপিসিসির সর্বশেষ সিনথেসিস প্রতিবেদনে কার্বন নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমানোর অপরিহার্যতার কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আর কার্বন নিঃসরণের বেশির ভাগটাই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।’

LEAVE A REPLY