৯৯৯-এ ফোন করে বন্ধ হয়েছে ২৬ হাজার বাল্যবিবাহ

বাল্যবিবাহের প্রতীকী ছবি

সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহের আয়োজন করে পরিবার। স্থানীয় এক চৌকিদার জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে বিষয়টি জানান। কল পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করে পুলিশ। একই সঙ্গে মেয়েকে নির্দিষ্ট বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেওয়ার বিষয়ে মা-বাবার কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়।

গত ৮ আগস্ট ভোলা সদরের দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। ভোলা মডেল থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান জানান, ৯৯৯-এ এক চৌকিদারের কল পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। ইউএনও মহোদয় এতে সহায়তা করেন। পরে মা-বাবা মেয়ে ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেওয়ার বিষয়ে পুলিশকে মুচলেকা দেন।

জাতীয় জরুরি সেবার ওই নম্বরে এভাবে কল দিয়ে গত ছয় বছরে প্রায় ২৬ হাজার বাল্যবিবাহ ঠেকানো হয়েছে। ৯৯৯-এ কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জানান, বাল্যবিবাহ ঠেকানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, এমনকি মেয়ে নিজেও ওই নম্বরে কল দিয়েছে।

ভোলার ওই মেয়ের বাবা সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘বাল্যবিবাহ দেওয়া যে দণ্ডনীয় অপরাধ পুলিশ আমাদের তা বুঝিয়েছে।

তা ছাড়া মেয়ের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিয়তার দিকে যেতে পারে। এ জন্য আমি পুলিশকে মুচলেকা দিয়েছি, আমার মেয়ের নির্দিষ্ট বয়স না হলে আমি বিয়ে দেব না। সে এখন পড়াশোনা করবে।’

গত ৭ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদরের বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের আমান উল্লাহপুরে ৯৯৯-এর কলে আরেক মাদরাসা ছাত্রীর (১৩) বিয়ে বন্ধ করে পুলিশ। একই সঙ্গে মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেবে না বলে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন ওই ছাত্রীর মা-বাবা।

সদর থানার ওসি সাইফ উদ্দিন আনোয়ার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই ছাত্রীর বিয়ের আয়োজনের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিয়েতে রাজি ছিল না ওই ছাত্রী। এতে তার এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দেয় সে। পরে এই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়।

ওসি জানান, যখন এ ধরনের অভিযোগ আসে, প্রাথমিকভাবে পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। অনেক সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানাও করা হয়।

৯৯৯-এ কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানান, যখন কলার (ফোন করা ব্যক্তি) বাল্যবিবাহর মতো ঘটনা আমাদের জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক সময় তাঁদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। বাল্যবিবাহসহ যেকোনো জরুরি সেবা সংশ্লিষ্ট কাজে আমরা তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্সের সহায়তা চেয়ে থাকি। তারা সেভাবে নাগরিকদের সেবা দেয়।

৯৯৯-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সেবাটি চালু হয়। সে সময় থেকে চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ছয় বছরে মোট পাঁচ কোটি ১২ লাখ ২১ হাজার ২৮৫টি কল এসেছে। এর মধ্যে বাল্যবিবাহসংক্রান্ত কল এসেছে ২৫ হাজার ৯১৭টি। এসব কলে তাত্ক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হয়েছে।

এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ড, নির্যাতন, নারী ও শিশু অপহরণ, চুরি যাওয়া গাড়িসহ অন্যান্য জিনিস উদ্ধার, নবজাতক উদ্ধার, বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধারসহ বিভিন্ন ঘটনায় অনন্ত ১৫ ধরনের সেবা দিয়েছে সংস্থাটি। সেবা দেওয়া হয়েছে মোট দুই কোটি ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৮টি কলের, যা মোট কলের ৪২.৩২ শতাংশ। দুই কোটি ৯৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৯৭টি কল ছিল সেবা দেওয়ার অযোগ্য, যা মোট কলের প্রায় ৫৮ শতাংশ।

সমাধানযোগ্য মোট কলের বিপরীতে ৮২.৭৩ শতাংশ পুলিশি সেবা, ৮.১৬ শতাংশ ফায়ার সার্ভিস সেবা ও ৯.১১ শতাংশ অ্যাম্বুল্যান্স সেবা দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে ৯৯৯-এ প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার কল আসছে। প্রতি মিনিটে ১০০টি কলে সাড়া দিতে পারে এই সেবা। এর মধ্যে ৮০টি ইনকামিং ও ২০টি আউটগোয়িং।

শিগগির জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে ৯৯৯-এ একটি সেল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে কল করে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিয়মের অভিযোগ দেওয়া যাবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন।

জাতীয় জরুরি সেবায় দায়িত্বরত পরিদর্শক (মিডিয়া) আনোয়ার সাত্তার জানান, কলসংখ্যা আরো বাড়ানোর সক্ষমতা চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৯৯৯-এ কেউ ফোন করে সহায়তা চাইলে সমস্যার ধরন, নাম-পরিচয় ও ঠিকানা জেনে প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্স সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি।’

রাজধানীর আবদুল গণি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

সম্প্রতি ওই দপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক কর্মী ডেস্কে বসে কাজ করছেন। কলটেকাররা কল রিসিভ করে সেবাপ্রার্থীদের সমস্যার কথা শুনছেন এবং সমাধানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাচ্ছেন। কলটেকারদের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে কাজ করেন তাঁরা।

৯৯৯-এর প্রধান ও অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, কল করে তাত্ক্ষণিক সেবা পাওয়া যায় বলেই ৯৯৯-এ মানুষের আস্থা দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে কিভাবে সেবা আরো বাড়ানো যায়, সেভাবে আমরা কাজ করছি। এখন জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, তাই আগের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কল কম আসে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জানা মতে অনেকে ৯৯৯-এ কল করে জরুরি ভিত্তিতে সেবা পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে ৯৯৯ প্রশংসার দাবিদার। তবে সরকারিভাবে একটা জরিপ চালানো উচিত ৯৯৯-এ কল করে কোন সেক্টরের কী পরিমাণ সেবা পেয়েছেন ভুক্তভোগীরা এবং আরো কোন কোন সেক্টরে সেবা চান নাগরিকরা। সেভাবে জরুরি বিবেচনায় আরো কিছু সেক্টর ৯৯৯-এর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলে মনে করছি।’

LEAVE A REPLY