নিরাপত্তা থাকবে ইসরায়েলের হাতে শাসনকাজের দায়িত্ব ফিলিস্তিনিদের

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ির ভেতর ধ্বংসস্তূপে কিছু খুঁজছেন এক ফিলিস্তিনি নারী

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হলে গাজার ভবিষ্যৎ শাসনপদ্ধতি কী হতে পারে তার প্রস্তাবিত রূপরেখা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। বৃহস্পতিবার রাতে পরিকল্পনাটি প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, গাজা ভূখণ্ডে সীমিত ফিলিস্তিনি শাসন থাকবে। তবে বর্তমানের শাসক হামাস আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করবে না। শতভাগ ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত ভূখণ্ডটির সামগ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনি সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে, এ পরিকল্পনার ব্যাপারে তাদের মনোভাব ইতিবাচক নয়। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা বলেছে, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আরব শান্তি উদ্যোগের কাঠামোর অধীনে তাঁরা জেরুজালেমকে রাজধানী করে ইসরায়েলি দখলদারির অবসান এবং ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র দেখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রেসিডেন্সি বলেছে, এটি এই শর্তগুলোর বাইরে যেকোনো পরিকল্পনা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করে। গাজার বাইরে ফিলিস্তিন অধ্যুষিত অন্য প্রধান এলাকা ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি পৃথক বা যৌথ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

সেখানেই ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক সমর্থিত মাহমুদ আব্বাস সরকারের (পিএ) অবস্থান। গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত ছিল। অবরুদ্ধ ছিটমহলটির হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শিশুসহ বেশ কিছুসংখ্যক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ইয়োভ গ্যালান্টের ‘চার কোণ’ পরিকল্পনার অধীনে ইসরায়েল গাজার সার্বিক নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে রাখবে।

ইসরায়েলি বোমা হামলায় যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, একটি বহুজাতিক বাহিনী তার পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেবে। প্রতিবেশী মিসরও এ পরিকল্পনার অধীনে একটি ভূমিকা পালন করবে। তবে তা কী, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। নথিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিরা গাজা অঞ্চলের দৈনন্দিন শাসন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, ‘গাজার অধিবাসীরা ফিলিস্তিনি, কাজেই ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোই এর দায়িত্বে থাকবে এই শর্তে যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতামূলক পদক্ষেপ বা হুমকি আসবে না।

ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার ঘটনা তদন্তের জন্য ওঠা কিছু নাম নিয়ে কয়েকজন ক্ষুব্ধ মন্ত্রীর আপত্তির কারণে বৈঠকটি ভেঙে যায় বলে জানা গেছে।

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা ইসরায়েলে গভীর মতবিরোধের সৃষ্টি করেছে। নেতানিয়াহু সরকারের কিছু কট্টর ডানপন্থী সদস্য বলেছেন, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের গাজা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে উৎসাহিত করা উচিত। তবে গাজায় ইহুদি বসতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো বিতর্কিত প্রস্তাবগুলোকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ এবং ইসরায়েলের কয়েকটি মিত্র দেশ ‘চরমপন্থী’ ও ‘অকার্যকর’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টের প্রস্তাবগুলো তাঁর মন্ত্রিসভার কয়েকজন সহকর্মীর তোলা প্রস্তাবের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি নেতারা হয়তো তা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। তাঁরা বলে আসছেন, ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পরে অবশ্যই গাজাবাসীকেই অঞ্চলটি পরিচালনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার দিতে হবে। গাজার ভবিষ্যৎ শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে নিজের মত বিস্তারিতভাবে জানাননি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। তবে তিনি বলেছেন, গাজায় যুদ্ধ আরো কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। এই যুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য হামাসকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা।

গ্যালান্টের পরিকল্পনায় গাজা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী কিভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তারও রূপরেখা রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গাজা উপত্যকার উত্তরে আরো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক কৌশল গ্রহণ করবে। সেখানে অভিযানের মধ্যে থাকবে সেনাদের হানা, হামাসের সুড়ঙ্গ ভেঙে ফেলা এবং বিমান ও স্থল হামলা। দক্ষিণে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামাস নেতাদের খুঁজে বের করা এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

হামলা ও প্রাণহানি পরিস্থিতি

ইসরায়েল গতকালও ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরগুলোতে হামলা অব্যাহত রাখে। মাগাজি, নুসেইরাত, বুরেইজি শিবিরসহ দেইর আল বালার কাছে তীব্র বোমাবর্ষণের খবর পাওয়া যায়। এর আগে বৃহস্পতিবার আইডিএফ বলেছে, তারা গাজা সিটি, খান ইউনিসসহ গাজার উত্তর ও দক্ষিণে বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হেনেছে। তারা বলেছে, ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামোর’ ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আইডিএফ কয়েকজন কথিত জঙ্গিকে হত্যা করার কথাও বলেছে। ইসরায়েলি সেনা কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা সেনাদের কাছেই বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। আইডিএফ আরো জানায়, তাদের এক বিমান হামলায় ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের জ্যেষ্ঠ কর্মী মামদুহ লোলো নিহত হয়েছেন।

হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, খান ইউনিসের পশ্চিমে আল-মাওয়াসিতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৯ শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়েছে। উপকূলের কাছের ছোট শহর আল-মাওয়াসিকে ইসরায়েলি বাহিনী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘নিরাপদ স্থান’ হিসেবে মনোনীত করেছিল। সেখানে হামলার বিষয়ে হামাসের দাবি নিয়ে আইডিএফ কোনো মন্তব্য করেনি।

অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন লি বলেছেন, “গাজার কোনো জায়গা নিরাপদ নেই। আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি এবং কথিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া উচিত নয়।”

জাতিসংঘে লেবাননের অভিযোগ

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে লেবানন ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সালেহ আল-আরুরির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছে। অভিযোগে বলা হয়, ইসরায়েলই বৈরুতের সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যাতে গত মঙ্গলবার আল-আরুরির মৃত্যু হয়। ইসরায়েল এতে জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি। বৈরুতের একটি ভবনে ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আরুরিকে হত্যা করা হয়।

আবার মধ্যপ্রাচ্যে ব্লিনকেন

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এ সপ্তাহেই আবার মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যাচ্ছেন। তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন সরকারের কর্মকর্তা ও ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামাসের নেতা সালেহ আল-আরুরির হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে তাঁর সফর হতে যাচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি

LEAVE A REPLY