মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি

৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালের আজকের দিনে যমুনা নদী ফেরিঘাটে ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িসহ নদীতে পড়ে প্রাণ হারান চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির ও অভিনেত্রী টিনা খান। টিনা খানের মেয়ে রোজা খন্দকার রিমু এই সময়ের একজন অভিনেত্রী। মায়ের স্মৃতি ও নিজের কথা বলেছেন রিমু। লিখেছেন হৃদয় সাহা

শুধু মনে আছে যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু খেয়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘রান্না করে গেছি, সময়মতো খাবে।’ কিন্তু মা আর ফেরেননি। এখনো আমি মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি

‘কিছুদিন আগে শুটিংয়ে একজন সিনিয়র সহকর্মী জানতে পারেন আমি টিনা খানের মেয়ে। তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।

আমার মায়ের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন তিনি। আমাকে শোনালেন, অভিনয়ে আমার মায়ের নিবেদনের কথা। একটা ছবির দৃশ্যে মাকে তিনি জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, মায়ের হাতের চুড়ি ভেঙে হাত কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন, মা তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, অভিনয়টা চালিয়ে যেতে।

এ পর্যন্ত শুনে আমি ভাবছিলাম নিজের কথা, আমিও তো একজন অভিনেত্রী। এমন অবস্থায় আমি হলে কী করতাম!’, এ পর্যন্ত বলে একটু থামলেন রিমু। মায়ের সহকর্মীর কাছ থেকে মা সম্পর্কে শোনা গল্পটা শেয়ার করে আবারও আবেগাপ্লুত  হয়ে ওঠেন রিমু।

মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি

টিনা খান যখন মারা যান, রিমুর বয়স তখন মাত্র সাড়ে চার বছর।

ওই বয়সের তেমন কিছুই মনে নেই। তবে শেষ দেখার কথা মনে আছে তাঁর, “শুধু মনে আছে যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু খেয়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘রান্না করে গেছি, সময়মতো খাবে।’ কিন্তু মা আর ফেরেননি। এখনো আমি মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি। তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি, সেসবে হাত বুলিয়ে মায়ের পরশ পাই।

” 

রিমুর বাবা খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন আর্মি অফিসার। মা মরা ছোট্ট মেয়েটিকে সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। নতুন মা-ও রিমুকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। মাহারা রিমুর ওপর নেমে আসে একাকিত্ব। ছোট্ট রিমুর পাশে এসে দাঁড়ান খান আতাউর রহমান। রিমু বলেন, ‘শ্রদ্ধেয়  খান আতাউর রহমান দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন ভারতেশ্বরী হোমসে, ছুটিতে বেড়াতে আসতাম আখতারুজ্জামান মামার বাসায়। আমার শৈশব এভাবেই কেটেছিল।’

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মায়ের ডায়েরি হাতে পেয়েছিলেন। কবিতাভরা ডায়েরি। সেখানে ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতাও। কিন্তু ভারতেশ্বরী হোমসে নিয়ে যাওয়ার পর হারিয়ে ফেলেন সেই ডায়েরি। এ নিয়ে ভীষণ আফসোস রিমুর।

আলমগীর কবিরের প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন টিনা খান। তাঁর পরিচালনায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মণিকাঞ্চন’-এও অভিনয় করেছিলেন। ২০ জানুয়ারির আগের দিন তাঁরা বগুড়া গিয়েছিলেন নতুন চলচ্চিত্র সংসদ উদ্বোধন করতে। সেখানে আবু সাইয়ীদের ‘আবর্তন’ প্রদর্শিত হয়েছিল। আলমগীর কবির, টিনা খান, মোরশেদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আলোকচিত্রশিল্পী মুনিরা মোরশেদ মুন্নী ঢাকা থেকে গাড়িতে করে বগুড়া গিয়েছিলেন। পরদিন দুপুরেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। আলমগীর কবির গাড়ি চালাচ্ছিলেন, পাশের সিটে টিনা খান। পেছনের দুই সিটে মোরশেদুল ইসলাম ও মুন্নী দম্পতি। সন্ধ্যায় যমুনা নদীর নগরবাড়ী ঘাটে পৌঁছান তাঁরা। ফেরিতে ট্রাক উঠছে। ট্রাকগুলো উঠে গেলেই আলমগীর কবিরদের গাড়ি উঠবে ফেরিতে। মোরশেদুল ইসলাম গেলেন ফেরির টিকিট কাটতে। এরই মধ্যে মালামাল বোঝাই একটি ট্রাক ডানদিকে ঘোরাতে গিয়ে তাঁদের গাড়িটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, গাড়ি পড়ে যায় নদীতে। সঙ্গে সঙ্গে একজন খালাসি নদীতে নেমে একজনকে উদ্ধার করলেন, তিনি মুনিরা মোরশেদ মুন্নী। বাকি দুজনের খোঁজ নেই। রাত ১১টার দিকে পাবনা থেকে উদ্ধারকারীরা এলেন। ৪০০ ফুট নিচ থেকে গাড়িটি টেনে তোলা হলো। সঙ্গে উঠে এলো ‘ধীরে বহে মেঘনা’ পরিচালক ও ‘প্রিন্সেস টিনা খান’ অভিনেত্রীর মরদেহ।

রিমুর কৈশোরের বহু ঘুমহীন রাতের কারণ ছিল মায়ের এই আকস্মিক মৃত্যু। ২০০৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় আসেন  রিমু। অভিনয়ের ইচ্ছা একদমই ছিল না। চেয়েছিলেন পাইলট বা চিকিৎসক হবেন। হলো না, চলে এলেন মায়ের পেশায়। কিভাবে? রিমু বলেন, “আখতারুজ্জামান মামা তখন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে। উনার দুই ছাত্র শর্টফিল্ম বানাচ্ছেন, সেখানে মাত্র দুইটা দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য একটা মেয়ে প্রয়োজন। মামার সঙ্গে আলাপ করে তাঁরা আমায় অভিনয়ে নেন। এরপরই কৌতূহলী হয়ে কিছু ফটোশুট করি। একজন পাঠালেন ইবনে হাসান খান ভাইয়ের কাছে।

তখন লাক্স সুপারস্টারদের নিয়ে ধারাবাহিক ‘পৃথিবীর সব রূপ মিশে আছে ঘাসে’ নির্মাণ করছিলেন আরিফ খান। ওখানেই আমি বলতে গেলে প্রথম অভিনয় করি। প্রথম সিনেমা করি ‘গুরু ভাই’। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি ধারাবাহিক ‘এফএনএফ’ ও চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ করার পর। এরপরই আমার কাছে অফার আসা শুরু করে।”

টিভি নাটকের ব্যস্ত একজন অভিনেত্রী, প্রায় প্রতিদিনই শুটিং করতে হয়। স্বল্প উপস্থিতির চরিত্র যেমন করেন, তেমনি করেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও। বেশির ভাগ নাটকেই তাঁকে গতানুগতিক কমেডি করতে দেখা যায়, এসব নিয়ে নিজেও সন্তুষ্ট নন। আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘সারা জীবন বলতে গেলে একাই বড় হয়েছি। বাবাও মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। ব্যক্তিগত জীবনে এখনো একাই আছি। আমার সেভাবে অভিভাবক ছিল না, আমাকে ভালো ভালো চরিত্র বা প্রধান ভূমিকায় নির্বাচন করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। তা ছাড়া আমার গলার স্বর ভাঙা হওয়ার কারণে অনেকে আগ্রহ দেখিয়েও পিছিয়ে গিয়েছিলেন।  আখতারুজ্জামান মামাও পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। এরপর আমার নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়েছে।

অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানা ধরনের চরিত্রই করতে হয়েছিল। পরে সাগর জাহান আমাকে নিয়মিতভাবে নাটকে নেওয়া শুরু করেন। এখন নিলয় আলমগীর ও মহিন খান আমাকে প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে  নির্বাচন করছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে পছন্দ করেন বলেই এখন আমার ব্যস্ততা ও পরিচিতি বেড়েছে।’মা টিনা খানের ইচ্ছা ছিল চোখ দান করে যাওয়ার। মায়ের সেই অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেছেন নিজের চোখ দান করে। এরই মধ্যে লায়ন্সের সঙ্গে সব চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। আজ মায়ের মৃত্যুদিনে মিরপুরে একটি অনাথ আশ্রমে গিয়ে সময় কাটাবেন। পাঁচ বছর ধরে এই কাজ করছেন রিমু। নিজে অনাথ ছিলেন, সে কারণে বিশেষ এই দিনে অনাথদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট নিজের করে নিতে চান রিমু, হতে চান তাদের সমব্যথী।

মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি
টিনা খানের সঙ্গে চার বছর বয়সী রিমু। এটিই মায়ের সঙ্গে সর্বশেষ ছবি। ছবি : ফারুক আহম্মেদ পিজু

LEAVE A REPLY