পরীক্ষাতেই আটকে আছে নগর পরিবহন

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসিলার দিকে যেতে সামান্য এগোলে হাতের বাঁদিকে একটি যাত্রীছাউনি। এই ছাউনিতে রয়েছে নগর পরিবহনের বাস কাউন্টার। কিন্তু দিনভর এর সামনে বিভিন্ন পণ্যের ভাসমান দোকান বসায় ছাউনিটি যাত্রীদের নজরে পড়ে না। এভাবে আড়ালে চলে যাচ্ছে এককেন্দ্রিক নগর পরিবহনের ধারণাটি।

ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসে পরিচালনা করার লক্ষ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রবর্তন করে সিটি করপোরেশন। এই ধারণাটির পরীক্ষামূলক চলাচল এখনো শেষ হচ্ছে না, অথচ দুই বছর পার হয়েছে।

পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস মালিকরা এই পদ্ধতিতে মুনাফার নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন সফল না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাস রুট রেশনালাইজেশনের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়।

বিআরটিএর হিসাব বলছে, ওই সময় এই পথে রজনীগন্ধা, মালঞ্চ, মিডলাইন, সিটি লিংকসহ ১৩টি রুটের ৩৮২টি বাস চলাচল করত। সেসব বাস পরবর্তী এক মাস অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারি এখন শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু পথ থেকে ওই বাসগুলো এখনো সরেনি।

অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাস ঠিকই সড়কে চলছে, আর উধাও হচ্ছে নগর পরিবহনের বাস। শুরুতে ট্রান্সসিলভা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাসকে রেশনালাইজেশনের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়। লোকসানের মুখে বাস কম্পানিটি সরে গেছে।

অন্য একটি কম্পানির কিছু বাস এই প্রক্রিয়ায় চলাচল করলেও রেশনালাইজেশনের মূলনীতি থেকে তারা সরে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসের ভরসায় ২১ ও ২৬ নম্বর দুটি রুট নামমাত্র টিকে আছে।

দুটি পথেই ৩০টি করে বাস চলার জন্য কাগজে অন্তর্ভুক্ত আছে।

বিআরটিসির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য সব জায়গা থেকে লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নগর পরিবহনে এখনো লোকসান দিয়ে যেতে হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, যেখানে প্রতি ৫ থেকে ১০ মিনিট পর পর কাউন্টারগুলোতে বাস আসার কথা, সেখানে এক ঘণ্টায়ও কোনো বাসের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। নগর পরিবহন নামে কোনো বাস সেবা আছে, সেটাই জানে না অনেক যাত্রী। বেশির ভাগ যাত্রীছাউনিতে ঘুরে টিকিট কাউন্টার পাওয়া যায়নি।

ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বেসরকারি বাস মালিকদের সমঝোতা হচ্ছে না। করপোরেশন চায় বাস রুট রেশনালাইজেশনের অধীনে ঢাকা নগর পরিবহন নামে সব নতুন বাস চালাতে। কিন্তু মালিকরা পুরনো বাস ফেলে দিতে প্রস্তুত নন।

মালিকদের দাবি, রাজধানীতে চলাচল করা ফিট বাসগুলোকে যেন রেশনালাইজেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। বাকি বাসগুলো সরকার কিনে নেবে। সেই টাকায় সড়কে নতুন বাস নামানোর অগ্রাধিকার পাবে পুরনো মালিকরা। কিন্তু এতে রাজি নন সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সঠিক নয়। সভাগুলোতে আমরা বার বার সহযোগিতা করার কথা দিয়েছি। কিন্তু নিজেরাই কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমরা বলেছি ফিট গাড়িগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নিতে, আর আনফিট গাড়িগুলো যেন সরকার কিনে নেয়, কিন্তু তারা সব নতুন গাড়ি নামাতে চায়। তাহলে নামাক, আমাদের তো কিছুই করার নেই।’

আবার সিটি করপোরেশনেরও ব্যর্থতা রয়েছে। রেশনালাইজেশনের রুটে শুরুতে চলা বাসগুলোকে তারা লাভজনক করতে পারেনি। একই রুটে অন্য বাস বন্ধ করতে না পারায় পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু বাস বন্ধ করা হলেও নাম পরিবর্তন করে আবার সড়কে চলছে। এখন যে বিআরটিসির ওপর ভরসা, সেই তারাও এই পথে লোকসান গুনছে। যে পরিমাণ বাস নামানোর কথা ছিল সেই কথাও রাখতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তৈরি করতে পারেনি পর্যাপ্ত অবকাঠামো। 

মালিকদের আস্থা অর্জন করতে না পারা, ব্যবসা দাঁড় করাতে না পারা, অবকাঠামো নির্মাণে পিছিয়ে থাকা, পরিকল্পনায় ত্রুটি, নীতিতে অটল থাকা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা—সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া সিটি করপোরেশন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই পুরো বিষয়টা সামনে থেকে দেখছি। অনেক কিছুতেই বাস মালিকদের রাজি করানো যাচ্ছে না। সব বাস এক কম্পানিতে না চললে শৃঙ্খলা আসবে না। কিন্তু মালিকরা এক কম্পানির নিচে আসতে চাইছেন না।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা যদি রাজনৈতিকভাবে মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলেই প্রকল্প সফল হওয়া সম্ভব। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের প্রকল্পের কার্যক্রম ও যাত্রীছাউনি থেকে শুরু করে সব ধরনের অবকাঠামোর অবস্থা জানতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে সার্ভে রিপোর্ট (জরিপ প্রতিবেদন) জমা দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে দুই রুট চালু হওয়ার পর আর কোনো রুট এখনো চালু করতে পারছে না ডিটিসিএ।  ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৮ নম্বর রুটে মোট ১০০টি নতুন বাস চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন করে এই চারটি রুটে ১০০টি নতুন বাস চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কিন্তু এতে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের অবস্থা করুণ দশায় পরিণত হয়েছে। একটি আদর্শ গণপরিবহনব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে শুধু কমিটমেন্টের অভাবে। বাস্তবায়ন করতেই হবে, এই ভাবনা না থাকলে এটা সফল হবে না। ভাবনার সঙ্গে এখন বাস্তবের কোনো মিল নেই। পাইলট প্রগ্রামের জন্য আনা বিআরটির বাসগুলো এখন ডিপোতে পড়ে থাকে। নগর পরিবহনের বাস দূরপাল্লায় ভাড়া দেওয়া হয়।

LEAVE A REPLY