বৈশ্বিক সংকট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজস্ব খাতে। এমনিতে ডলার সংকটে এলসি খোলার জটিলতায় পণ্য আমদানি খাত সংকুচিত হয়েছে। অপরদিকে বিগত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলছে রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর। অবরোধসহ নানা কর্মসূচির কারণে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে এসব খাত থেকে কমেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ৬ মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ ২৫৬৬০ কোটি টাকা কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিও কমছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
রাজস্ব আহরণ কমার কারণে ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধ নিয়ে চাপের মুখে পড়বে অর্থ বিভাগ এমন শঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যয় নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। কারণ সরকারের আয় না বাড়লে ব্যয় সম্ভব নয়।
অবশ্য নির্বাচনের আগে রাজস্ব আদায় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছিলেন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পণ্য ও খাতভেদে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ফাঁকি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেমন ইএফডি মেশিন স্থাপনের পর গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ভ্যাট আদায় হচ্ছে প্রত্যেক দোকান থেকে, যা আগে ছিল ৪-৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজস্ব আদায়ের নেতিবাচক কারণ হলো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম থাকা। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ও অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাস, ট্রাক ও রেলে ঘটছে অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা। ফলে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। ব্যাহত হয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও।
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, আবগারি ও অন্যান্য খাত থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর আদায় করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। সেখানে দেখানো হয়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রথম ছয় (জুলাই-ডিসেম্বর) মাসে লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জনের হার ৮৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই বৈঠকে আরও বলা হয়, গত অর্থবছরের এক সময়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার অর্জনের হার ছিল ৯১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ওই বৈঠকে বলা হয়, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বদ্ধপরিকর এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) নিকট দায়বদ্ধ। বৈঠকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সচেষ্ট থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাস রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছিল। এক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
রাজস্ব আদায়ের একটি খাত রপ্তানি শুল্ক। কিন্তু নির্বাচনি অনিশ্চয়তা বিগত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই ৩ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। বিশেষ করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অক্টোবরে ১৪৮ কোটি মার্কিন ডলার, নভেম্বরে ৫০ কোটি ডলার ও ডিসেম্বরে ৩১ কোটি ডলার আয় কমেছে। লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছাড়াও গত ৩ মাসে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। এদিকে বৈশ্বিক ও ডলার সংকটের কারণেও আমদানি খাত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী এলসি খোলার ক্ষেত্রে জটিলতার মুখে পড়েন। বিলাসী পণ্য এখনো আমদানি বন্ধ আছে। নির্বাচনের আগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই থেকে নভেম্বর এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ, নিত্যপণ্যে ২০ শতাংশ, প্রাথমিক পণ্যে প্রায় ২২ শতাংশ, জ্বালানি পণ্যে ২২ শতাংশ ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালে প্রায় ২০ শতাংশ মার্কিন ডলার এলসি কম খোলা হয়েছে। যে কারণে আমদানি ও রপ্তানি খাত থেকে রাজস্ব আহরণ কমছে গত ৬ মাসে ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভ্যাট আদায় কমেছে ১১ শতাংশ। এটি মূলত পাইকারি ও খুচরা বাজারে স্থবিরতার কারণে হয়েছে। যদিও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে নতুন সরকার। ইতোমধ্যে পণ্যের এলসি খোলার ওপর আরোপিত মার্জিন তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, রাজস্ব আহরণের ঘাটতি প্রতিবছরই হচ্ছে। এটি আমাদের একটি বড় সমস্যা। এখান থেকে বের হতে হলে কর জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। এখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার দরকার। প্রয়োজনে কর কমিশন গঠন করতে পারে সরকার। রাজস্ব আদায়ে ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহারসহ নানামুখী সংস্কার আনতে হবে। তাহলে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ধারাবাহিকতায় ফিরবে। তবে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
সূত্রমতে, রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) থেকে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বছর এডিপির আকার গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে এসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয় অর্থ বিভাগ থেকে। বিশেষ করে ধীরগতির প্রকল্প থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন, ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতিসংক্রান্ত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়। এছাড়া উন্নয়ন খাতের কোনো অর্থ ব্যয় না হলে সেটি ভিন্ন খাতে (পরিচালনা) স্থানান্তর করতে নিষেধ করা হয়। অর্থ ছাড়ে কড়াকড়ি আরোপ করে এখন ১৮ হাজার কোটি টাকার এডিপি কাটছাঁট করা হচ্ছে। ফলে এখান থেকেও বছর শেষে রাজস্ব আদায় কমবে।
অর্থ বিভাগের ভাবনা : রাজস্ব আদায়ের সার্বিক এ পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪) অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। রাজস্ব আয় কমলে ব্যয়ের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এমনিতে সরকারিভাবে গাড়ি কেনা বন্ধ। এছাড়া কৃচ্ছ সাধনের আওতায় সব ধরনের ভূমি অধিগ্রহণসহ অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। যে কারণে এসব খাতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এতে রাজস্ব আদায়ের চাপ কমে আসবে।