ফেসবুকে ফাঁদে ফেলে ভিডিও বানিয়ে পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল, গ্রেপ্তার ৪

প্রতীকী ছবি। (সংগৃহীত)

ফেসবুকে বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, মেয়র, আমলা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীসহ ছাত্রদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া একটি সংঘবদ্ধ চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ শাখা।

ডিবি জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসককে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় অঞ্জলি শর্মা নামের এক ভারতীয় নারী। তিনি নিজেকে রাজস্থানের নারী আইপিএস অফিসার বলে দাবি করেন। সেবা দানকারী পেশায় নিয়োজিত ভেবে ওই চিকিৎসক তাঁর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন।

পরে মেসেঞ্জারে তাঁদের চ্যাট হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে অঞ্জলি শর্মা ওই চিকিৎসকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর জেনে নেযন। দুই-একবার চ্যাট করার পর হঠাৎ অপর প্রান্ত থেকে আসে ভিডিও কল। তখন চিকিৎসক ফোন রিসিভ করার পর দেখেন এক নারীর যৌন দৃশ্য।

অপ্রত্যাশিত এই ভিডিও দেখে সেই চিকিৎসকের ঘোর কাটতে না কাটতেই অপর প্রান্ত থেকে পুরো বিষয়টির ভিডিও ধারণ করা হয়।

এ ঘটনার কয়েক মিনিট পরই একই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে একটি অডিও কল আসে। সেখানে পুরুষ কণ্ঠে সেই চিকিৎসককে যৌন বিকৃতি ও চর্চার অভিযোগ করা হয়। পাশাপাশি তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, পাঁচ লাখ টাকা না দিলে পুরো ভিডিওটি তাঁর স্ত্রী, সহকর্মী ও বন্ধুদের কাছে পাঠানো হবে।

ভয়ে ও লজ্জায় সেই চিকিৎসক এক দিন মোবাইল বন্ধ রাখেন। কিন্তু পরে কোনো উপায় না দেখে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে পাওয়া নির্দেশ মেনে একাধিক বিকাশ নম্বররে ৬৫ হাজার টাকা পাঠান।

সম্প্রতি একই রকম ফাঁদে পড়ে এক লাখ ২০ হাজার টাকা হারিয়ে লজ্জা ও আত্মগ্লানিতে নিজেকেই নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলেন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের এক শিশু বিশেষজ্ঞ। পূজা আগারওয়াল নামের এক ভুয়া চিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে অর্থ হারালেও এ যাত্রায় তাঁকে সম্মান হারাতে হয়নি।

অন্যদিকে পাবনার এক প্রকৌশলীর আত্মবিশ্বাস ছিল, তিনি ম্যাথ এবং সাইন্টিফিক অ্যানালিসিসে দক্ষ।

কিন্তু নীরা গুপ্তা নামের ভারতের রাজস্থানের এক স্কুল শিক্ষিকার সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হওয়ার পর একই রকম প্রতারণার শিকার হয়ে ৫০ হাজার টাকা খুইয়েছেন তিনি।

এ ছাড়া নাটোরের এক পৌরসভার মেয়র ফেসবুকে পরিচিত হন ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সোনিয়া গয়ালের সঙ্গে। মেয়র তাঁর এ বন্ধুর সঙ্গে মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করার অল্প সময় পরই শিকার হন অশ্লীল ভিডিওর সেই প্রতারণার। খেসারত হিসেবে টাকা দিতে দিতে এক পর্যায়ে হারপিক খেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েও বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে। কৌতুহল আর নির্বুদ্ধিতার খেসারত হিসেবে দিতে হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।  

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (ডিএস) ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করেন চেন্নাই বিমানবন্দরের নারী কাস্টমস কর্মকর্তা স্বপ্না সিংয়ের সঙ্গে। ফেসবুক থেকে মেসেঞ্জার, মেসেঞ্জার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করার পর একই রকম ফাঁদে পড়েন তিনি। বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বদলি হয়ে যান ঢাকা থেকে বরিশালে। কারণ আত্মবিশ্বাসী এ আমলা প্রতারকের কথা মতো বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্টে একটি টাকা দিতেও রাজি হননি। ফলে তাঁর বন্ধু, সহকর্মী ও বসদেরকে ওই প্রতারক আপত্তিকর ও অশ্লীল ভিডিও পাঠিয়েছেন। ঊর্ধ্বতনগণ তাঁর ব্যাখ্যা না শুনে তাঁকে বদলি করে দেয়। পরিবারেও বাজে ভাঙনের সুর।

সম্প্রতি ফেসবুকে একই ধরনের প্রতারণার বলির পাঠা হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের এক ছাত্র, কুড়িগ্রামের ছাত্রলীগের এক নেতা, গাজীপুরের গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিযের এক ব্যবসায়ীসহ অনেকে। বিবেকের দংশন, লোকলজ্জা এবং পরিবারে অশান্তির ভয়ে হাজারো বা লক্ষাধিক টাকা হারিয়ে নির্ঘুম রাত্রি কাটালেও তাঁদের অধিকাংশই অভিযোগ জানাননি আদালত কিংবা থানাতে।

পরে নিজেরা কোনো অপরাধ করেননি—এমন আত্মবিশ্বাস থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সেই আমলা এবং বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই চিকিৎসক যথাক্রমে যাত্রাবাড়ী এবং পল্লবী থানায় মামলা করেন। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম মাঠে নামে। ডিবি লালবাগের স্পেশাল টিমের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশ শেরপুর জেলা থেকে শিক্ষার্থী এহসাম, কুমিল্লা থেকে ফ্রিল্যান্সার গালিব, ফেনী থেকে বিকাশ এজেন্ট শাহাদত এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে এক্সপোর্ট/ ইমপোর্ট ব্যবসায়ী শাওনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিকাশ এবং নগদ অ্যাকাউন্টে প্রতারণার এই বিশেষ ধরনের কথাও জানতে পারে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ।

পল্লবী ও যাত্রাবাড়ী থানায় দায়েরকৃত মামলা দুটির তদন্তকালে ডিবি পুলিশ জানতে পেরেছে, ফাঁদে পরা ভুক্তভোগী এসব আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, মেয়র, ছাত্র বা ব্যবসায়ী—সবাই পুরুষ ও বাংলাদেশের নাগরিক।

LEAVE A REPLY