চিকিৎসা খাতে মাফিয়ারা কাজ করছে: হাইকোর্ট

সংগৃহীত ছবি

দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা খাত নিয়ে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ায় মেডিকেলের বিষয়গুলোতে (চিকিৎসা খাতে) মাফিয়ারা কাজ করছে।’

রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ কথা বলেন। দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবেদন এবং শিশু আয়ানের মৃত্যুর ক্ষতিপূর সংক্রান্ত রিটে এক আইনজীবীর যুক্ত হওয়া নিয়ে শুনানি চলছিল তখন।
 
আদালতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।

রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কুমার দেবুল দে। আর ইন্টারভেনার হিসেবে রিটে যুক্ত হতে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

শুনানির এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের অনিয়ম-অবহেলার দিকে ইঙ্গিত করে হাইকোর্ট বলেন, ‘চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

শুধু আদেশ দিলাম আর পত্র-পত্রিকায় নাম আসল, এটা আমরা চাই না। আমরা কারো জন্য কাজ করি না। আমরা কারো পক্ষে না। দেশের মানুষ যাতে সুফল পায় সে জন্য আদেশ দিতে চাই।

হয়তো এক দিনে বা রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কিন্তু আমরা এমন কিছু করতে চাই যাতে দেশের মানুষের, মানবজাতির উপকার হয়।’ 

দেশের লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা অবহেলার শিকার তার আগে আয়ানের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ বলেন, প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি যে পর্যবেক্ষণ ও মতামত দিয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর এবং চিকিৎসায় অবহেলার দায় অস্বীকার করা হয়েছে। 

শিশু আয়ানের ক্ষেত্রে চিকিৎসায় অবহেলার বিভিন্ন দিন তুলে ধরে এ আইনজীবী বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা, অসদাচরণ এবং হয়রানি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ নাগরিক এবং বিদেশি এর শিকার হচ্ছে।

যে কারণে ২০১৫ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা খসড়া আইনের আলোকে একটি ‘অভিযোগ ফোরাম’ দরকার। যেখানে চিকিৎসায় অবহেলা, অসদাচরণ এবং হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যেতে পারে। 

২০১৫ সালে এই আইনটির খসড়া তৈরি করা হলেও এখনও প্রণয়ন করা হয়নি। নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রক্ষা করার মত এখন পর‌্যন্ত দেশে কোনো নেই। ফলে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষা করা সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব। তখন হাইকোর্ট বলেন, দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা অবহেলার শিকার। বিষয়টি নিয়ে আমরা আদেশ দিব।

এরপর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। প্রতিবেদন উদ্বৃত করে তিনি বলেন, দেশে অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের সংখ্যা সংখ্যা ১ হাজার ২৭টি। আর নিবন্ধিত হাসপাতাল-ক্লিনিট রয়েছে ১৫ হাজার ২৩৩টি। 

এ পরিসংখান পেয়ে হাইকোর্ট জানতে চান, যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স নাই সেগুলোর কি হবে? জবাবে তুষার কান্তি রায় বলেন, এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনোটি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। হাইকোর্ট তখন বলেন, কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না তো। 

এরপর আইনজীবী কুমার দেবুল দে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালকে রিটে পক্ষ করলেও মূল প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পক্ষ করা হয়নি। 

তখন রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ বলেন, একটি ফাউন্ডেশনের অধীনে ইউনাইটেড হাসপাতালের সহপ্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে পক্ষ করা হয়নি। তখন হাইকোর্টও এতে সায় দিয়ে বলেন, সহপ্রতিষ্ঠান হলে যেকোনো একটিতেক পক্ষ করলেই হলো।

এরপর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রিটে ইন্টারভেনি হতে আবেদন করেন। এসময় তিনি কিছু গবেষণা ও পর‌্যালোচনা তুলে ধরে বলেন, ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি পর‌্যন্ত চিকিৎসায় অবহেলার ৭০ ঘটনা ঘটেছে। এ ৭০টি ঘটনা কেবল তিনটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হয়েছে। 

এ আইনজীবী বলেন, চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ওপর আক্রমনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই থেকে চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন ২৯টি ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর-প্রতিবেদন হয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসকদের পেশাগত আচরণ, দায় নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর বিভিন্ন বিধান, বাংলাদেশ, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং চিকিৎসায় অবহেলাসহ চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নের সমস্যা নিরসনে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ আইন কমিশনের সুপারিশ তুলে ধরেন শুনানিতে।

শুনানির পর হাইকোর্ট আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরের আবেদন গ্রহণ করে তাঁকে রিটে ইন্টারভেনি হিসেবে যুক্ত করেন।
      
এ আদেশের পর রিটকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ বলেন, ‘শিশু আয়ানের মৃত্যু ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবায় অবহেলা-অব্যবস্থাপনা, হয়রানি ও অসদাচরণ নিয়ে বৃহত্তর একটি আদেশ দিতে চাচ্ছেন। আগামী মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) আদেশের দিন ধার‌্য করা হয়েছে।’
  
‘লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরল না আয়ান: খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু’ শিরোনামে গত ৮ জানুয়ারি প্রতিবেদন ছাপে একটি জাতীয় দৈনিক। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে গত ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ। রিটে শিশুটির পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরে রিটে আবেদনকারী হিসেবে শিশুটির বাবা মো. শামীম আহমেদকে আবেদনকারী হিসেবে যুক্ত করে সম্পূরক আবেদন করা হয়। এ আবেদনে প্রাথমিক শুনানির পর গত ১৫ জানুয়ারি রুলসহ আদেশ দেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ। আয়ানের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সারা দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বা অনুমোদনহীন কতগুলো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সে বিষয়েও একটি প্রতিবেদন চান হাইকোর্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এক মাসের মধ্যে এ তালিকা দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া গত ১৫ বছরে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে কত জনের মৃত্যু হয়েছে, তিন মাসের মধ্যে সে তালিকাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দিতে বলা হয়। 

আর শিশু আয়ানের মৃত্যুতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শিশুটির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে আদালত রুল জারি করেন। এ আদেশের পর আয়ানের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ২৯ জানুয়ারি চার সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। শুনানির সময় প্রতিবেদনের সুপারিশকে ‘খুবই হাস্যকর’ এবং প্রতিবেদনটিকে ‘এক ধরনের আইওয়াশ’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। 

আদালত এও বলেন, ‘এতে (প্রতিবেদনে) নেগলিজেন্স (আয়ানের চিকিৎসায়) দেখা যাচ্ছে। শুনানির পর আদালত রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) আদেশের জন্য রেখেছিলেন। এর মধ্যে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক নিয়ে প্রতিবেদন দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক; যা রবিবার আদালতে উপস্থাপন করা হয়। 

LEAVE A REPLY