কর্মব্যস্ত জীবনে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের রাতে একটু সুন্দর সময় অতিবাহিত করতে বের হয়েছিলেন তারা। প্রিয়জনের হাতটি ধরে পরিপাটি হয়ে গিয়েছিলেন বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবনে। সাততলা এই ভবনের ছয় তলাতেই ছিল বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ আড্ডায় ব্যস্ত, তখনই রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে ভবনের দোতলার একটি রেস্টুরেন্টে হঠাৎ লাগে আগুন। শুরু হয় ছোটাছুটি। একটি মাত্র সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পদদলিত হন অনেকে। ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য তলায়ও। পুরো ভবনে অপরিকল্পিতভাবে থাকা সিলিন্ডার আগুনকে আরও ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে যায়। এভাবে পুড়ে, তীব্র ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এবং বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত পেয়ে মারা গেছেন নারী ও শিশুসহ অন্তত ৪৪ জন। আহত হন শতাধিক। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক ২২ জনসহ ৫০ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার খবর পেয়ে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। তাদের সহযোগিতায় ছিল পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে দোতলা রেস্টুরেন্টে আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আটকা পড়েন অসংখ্য মানুষ। এদের মধ্যে ১৫ জন নারীসহ ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। নিহত উদ্ধার হন দুজন। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪২ জনকে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় মর্মান্তিক দৃশ্য। রাত পৌনে বারোটা থেকে একটার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে থাকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স। সেগুলোতে থাকা মানুষের দেহের বেশিরভাগই নিথর। জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের বাইরে ছিল স্বজনদের ভিড় ও আহাজারি। পরে রাত ১টা ৫৫ মিনিটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ৪৩ জনের মৃত্যুর তথ্য জানান। এর মধ্যে ১০ জন মারা যান শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে, ঢাকা মেডিকেলে মারা যান ৩৩ জন। মন্ত্রী আরও জানান, ২২ জনকে নিয়েও তারা শঙ্কায় আছেন। তাদের সবারই কণ্ঠনালি পুড়ে গেছে। তাছাড়া রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
এদিকে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডারে লিকেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। ভবনের তৃতীয় তলা ছাড়া অন্য সব তলাতেই ছিল বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট। সিঁড়িসহ রেস্টুরেন্টগুলোর নানা স্থানে ছিল সিলিন্ডার। ওঠানামার জন্য সবাই লিফটই ব্যবহার করতো। এ কারণে আগুন লাগার পর সিলিন্ডার এবং কম ব্যবহৃত সিঁড়ি ক্ষতির মাত্রা কয়েক গুণে বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল না। এর ফলে নিজস্বভাবে শুরুতেই আগুন নেভানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করলেও তাদের নিয়ে অভিযোগ ছিল স্থানীয় মানুষের। এ সময় ভবনে আটকে পড়া স্বজনদের অনেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভও করেন। যদিও পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ অবস্থায় ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। পাশাপাশি এ ঘটনায় মামলা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এখানে কোনো নাশকতা ছিল কি না-তাও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।
আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ফায়ার সার্ভিসের মহপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, রাত ৯টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগার সংবাদ পাই। সিদ্দিকবাজার স্টেশন থেকে ৯টা ৫৬ মিনিটে প্রথম ইউনিট আসে। ১৩টি ইউনিট অগ্নি নির্বাপণ করে। তিনজন মৃত এবং ৪২ জনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছি। জীবিত অবস্থায় মোট ৭৫ জনকে আমরা উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, এই ভবনে একটি কাপড়ের দোকান ছিল। অন্যান্য তলায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ছিল। এখানে বিভিন্ন রকম গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। একেবারে অগ্নিচুল্লির মতো অবস্থা। তাই এখানে আগুন খুব দ্রুত বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে গেছে। আগুনে দগ্ধ না হয়ে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে অচেতন হয়েছেন। যারা মারা গেছেন, তারা নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাদের শরীরে পোড়ার দাগ কম। উদ্ধার হওয়া অচেতন ৪২ জনের মধ্যে ৪টি শিশু, ২১ জন নারী, বাকিরা পুরুষ।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, হতাহতের যাদের পাওয়া গেছে, তাদের বেশির ভাগকেই তিনতলা এবং চারতলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদের সবাই অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
দুই সন্তানসহ লাশ হলেন মা : মেয়ে আর্দিতা (১২) ও ছেলে সানের (৭) রেস্টুরেন্টে খাওয়ার বায়না মেটাতে সন্ধ্যায় শান্তিবাগের বাসা থেকে বের হন পপি (৩০)। বেইলি রোডের গ্রিন কজি কট শপিংমলের এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে সবাই লাশ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন পপির মা বাসনা। আহাজারি করে তিনি বলছিলেন, আমি কী পাপ করেছি যে এত বড় শাস্তি পেলাম। সব শেষ হয়ে গেল। তার সঙ্গে থাকা স্বজনেরা জানান, আগুনের সূত্রপাত হলে পপি তার স্বামী শিপন পোদ্দারকে ফোন করে জানান। এরপর আর কোনো সন্ধান না পেয়ে ছুটে আসেন ঢামেক হাসপাতালে। ঢামেক মর্গের সামনে এমন অসংখ্য স্বজনকে আহাজারি করতে দেখা যায়। কারও ভাই, কারও বোনের লাশের সন্ধানে তারা এখানে এসেছেন।