ঢাকার সবচেয়ে পুরনো ইফতারি বাজারে সেই চেনা দৃশ্য

চকবাজারে ইফতারি সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতা। গতকাল তোলা।

মোগল আমলে বাংলার তৎকালীন সুবাদার শায়েস্তা খান নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার চকবাজারের শাহি মসজিদ। তখন আজকের পুরান ঢাকাই শহরের প্রাণকেন্দ্র। এই শাহি মসজিদকে ঘিরেই পত্তন হয়েছে ঢাকার সবচেয়ে পুরনো ইফতারি বাজারের।

১৮৮১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী লেখক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ইউনানি চিকিৎসক  হেকিম হাবিবুর রহমান চকবাজারের বাহারি ইফতারির কথা লিখেছেন।

১৯৪৫ সালের দিকে বেতারের জন্য লেখা উর্দু ভাষার ‘ঢাকা আজসে পাচাস বারাস পেহেলে’ (‘৫০ বছর আগের ঢাকা’) কথিকায় তিনি বলেন, ঢাকার বাসিন্দারা তখন এই বাজার থেকে কিছু না কিছু ইফতারসামগ্রী কিনত।

গতকাল চকবাজারের শাহি মসজিদের সামনের সড়কে চোখে পড়ল সেই চেনা দৃশ্য। হরেক রকমের মুখরোচক ইফতারির পসরা, বিক্রেতাদের হাঁকডাক আর ক্রেতার ভিড়। দুপুর থেকে মসজিদের সামনের সড়কের পুরোটায় বসে বাজার।

সেখানে থাকে মোগল আমল থেকে বিবর্তিত নানা পদ, ভাজাপোড়া আর ঝাল-মিষ্টির বাহারি ইফতারি। পুরো এলাকায় ম ম করে খাবারের ঘ্রাণ। জোহরের নামাজের পর পর শুরু হয় হাঁকডাক। নামে জনস্রোত।

অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার ফাল্গুনের শেষে রাজধানীতে একটু বৃষ্টি ঝরেছে বলে চকের ইফতারির বাজারের আয়োজন শুরু হয়েছে কিছুটা দেরি করে। তবে বৃষ্টির পর দ্রুতই জমজমাট অবস্থা ফিরে আসে।

গতকাল দেখা গেল, মানুষের ঘন চলাচল আর সংকীর্ণ স্থানের ভেতরেই গরম কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে জিলাপি। ফুটন্ত তেলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে পেঁয়াজু, বেগুনি, সবজির বড়াসহ আরো নানা পদ। আগুনে ঝলসানো হচ্ছে নানা রকম কাবাব ও মাংসের পদ।

টেবিলে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে খাসির আস্ত রান, হাঁস, মুরগি, কবুতর, কোয়েল পাখির রোস্ট। আছে বটি, রেশমি, ক্ষীরি, জালি, সুতি কাবাবসহ আরো বহু পদ। তবে সব পদেরই দাম গত বছরের তুলনায় বেশি। গরুর মাংসের সুতি কাবাবের দাম এক হাজার ২০০ এবং খাসির এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি। খাসির রান প্রতিটি ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা, আস্ত হাঁস এক হাজার ২০০, মুরগি ৪৫০, কবুতর ৫০ এবং কোয়েল পাখির রোস্ট ৪০ টাকা। গরুর বটি কাবাব প্রতি প্লেট ২৫০ টাকা। টিকিয়া নার্গিস, মুঠি, কাঠি কাবাব প্রতিটি ৪০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। তন্দুরি চিকেন ১৫০ টাকা। দইবড়া ১০টির বাটি ৩০০ টাকা। ফালুদার বাটি ১০০ টাকা, ২৫০ মিলিলিটার পেস্তার শরবত ১৫০ টাকা। বেগুনি, পেঁয়াজু, সবজির বড়া আকারভেদে প্রতিটির দাম পাঁচ থেকে সাত টাকা।

চকবাজারে পেশাদার খাদ্য প্রস্তুতকারীরা যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন অনেক মৌসুমি বিক্রেতা। সারা বছর অন্য পেশায় ব্যস্ত থাকেন এমন বহু দোকানদার ইফতারি বিক্রিতে নেমে পড়েন। তাঁদের সবার একই বক্তব্য, পারিবারিক ধারাবাহিকতায় রোজার মাসে এই ব্যবসা করেন তাঁরা। এ নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। মুরগির মাংস, কিমা, মগজ, কলিজা, চিড়া, ডাল, সুতি কাবাব, আলু, ডিমসহ ১০ থেকে ১২টি মসলার সমন্বয়ে তৈরি একটি পদের নাম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।

প্রতিবছর রোজায় এই খাবার নিয়ে চকবাজারে বসেন মধ্যবয়সী আলী আমজাদ। জানালেন, তিনি ও তাঁর ছয় সহযোগীর সবাই সারা বছর ভিন্ন পেশায় ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু রোজায় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এই পদ বিক্রি করে আসছেন। এর আগে তাঁর বাবাও এই পেশায় ছিলেন। আলী আমজাদের কাছে রোজার মৌসুমি এই ব্যবসা ঐতিহ্য। এবার তিনি ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রি করছেন ৮০০ টাকা কেজি দরে।

LEAVE A REPLY