অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রে হতাহত বাড়ছে

দেশে অবৈধ অস্ত্রে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধের জেরে গত পাঁচ মাসে সারা দেশে ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সাড়ে সাত শর বেশি সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে দুই শতাধিক ব্যক্তি।  আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে তারা হতাহত হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত নভেম্বর থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসের বেশি সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধের জেরে ৭৬৯টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও গুলির ঘটনায় আহত হয় দুই হাজার ৫৬৩ জন। এর মধ্যে দুই শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাটির তথ্য মতে, গত  নভেম্বর মাসে ১৪ জন, ডিসেম্বরে ১৫ জন এবং ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সহিংসতায় ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর নির্বাচন-পরবর্তী সংঘর্ষে  ফেব্রুয়ারিতে ৬০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। চলতি মার্চ মাসের গতকাল রবিবার পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

পুলিশ সূত্র বলেছে, গত আড়াই মাসে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশুসহ ৯ জন নিহত হয়েছে। গুলিতে আহত শতাধিক। সব শেষ গত বুধবার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর দুর্গম চরাঞ্চল আলোকবালীতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় সেখানে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে কাজ করা এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য ধরে রাখতে সংঘর্ষ বাড়ছে।

তরুণ ও কিশোরদের হাতে চলে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় খুনাখুনি বেড়ে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় বলা হয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সরকার জানতে পেরেছে দেশে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি খারাপ প্রকৃতির মানুষের কাছে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রে তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে এসব অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হয় ওই সভা থেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতা, আধিপত্য বিস্তার, হত্যাকাণ্ডে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।

গত শুক্রবার কুমিল্লা নগরীসংলগ্ন শাসনগাছা বাস টার্মিনাল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে জামিল হাসান অর্ণব (২৭) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নাজমুল জামান (২৮) নামে একজনের ডান পায়ে, নিয়ামত উল্লাহর (৩৫) কোমরে, নুরুল আফসার মোহনের (২২) পিঠে ও নাজমুল হাসানের (২৬) হাতের নিচের দিকে গুলি লাগে।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ফিরোজ হোসেন বলেন, লেগুনাস্ট্যান্ড নিয়ে সংঘর্ষের জেরে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাতজনকে আটক করা হয়েছে।

গত ১১ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল এলাকায় নিজ বাড়িতে বড় ভাইয়ের অবৈধ পিস্তলের গুলিতে প্রতিবন্ধী ছোট ভাই সাব্বির হোসেন (১৬) নিহত হয়। পুলিশ বড় ভাই মো. সজীব হোসেনকে  গ্রেপ্তার করেছে। সজীবের দেওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, সে একটি সন্ত্রাসী দলের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটি পায়। রান্নাঘরে একটি প্লাস্টিকের বস্তার ভেতর রাখা পিস্তলটি বের করে নাড়াচাড়া করতে গেলে হঠাৎ ট্রিগারে চাপ পড়ে। এতে একটি গুলি বেরিয়ে তার ছোট ভাই সাব্বিরের কপালের বাঁ চোখের ওপরে গিয়ে লাগে।

বাউফল থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন এ তথ্য দিয়ে বলেন, গ্রেপ্তার সজীব এক অপরাধী চক্রের সদস্য। চক্রের সদস্যরাই পিস্তলটি তার কাছে রেখেছিল। অন্যদের গ্রেপ্তার করতে পারলে অস্ত্রের আসল রহস্য জানা যাবে। 

এ ঘটনার এক দিন আগে গত ররিবার ভোরের দিকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মো. আলম (৪৮) নামের এক ট্রাকচালককে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়।  

গুলিবিদ্ধ মো. আলম বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই দল সন্ত্রাসীর মধ্যে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত ৪ মার্চ সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ শ্রেণিকক্ষে আরাফাত আমিন নামের এক ছাত্রকে পায়ে গুলি করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। তাঁর কাছ থেকে এ পর্যন্ত দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১টি গুলি, চারটি ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে পুলিশ।

সন্ত্রাসীরা দেশেই তৈরি করছে আগ্নেয়াস্ত্র

গত ১২ মার্চ রাজধানীর বাড্ডা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. মোখলেছুর রহমান সাগর, মো. তানভির আহম্মেদ, অনিক হাসান, মো. আবু ইউসুফ সৈকত, রাজু হোসেন ও মো. আমির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে র‌্যাব-১০ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী চক্রের সদস্য। তাঁরা ভারত থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মোট ১৩টি অস্ত্র নিয়ে আসেন। এর মধ্যে ৯টি অস্ত্র তাঁরা উচ্চমূল্যে বিক্রি করেছেন। প্রথম চালানে আটটি অস্ত্র এনে সব কটি বিক্রি করেন। পরে আরো পাঁচটি অস্ত্র এনে তা থেকে একটি বিক্রি করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে চারটি পিস্তল, চারটি কার্তুজসহ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এসব সরঞ্জাম দিয়ে তাঁরা দেশেই অস্ত্র তৈরি করতেন।

র‌্যাব-১০-এর পরিচালক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সংঘবদ্ধ অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী চক্রের সদস্য। এই চক্রের সদস্যরা দেশেও অস্ত্র তৈরি করছেন।

বিজিবি উদ্ধার করেছে ১০৮ আগ্নেয়াস্ত্র

দেশের সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গত বছর ১০৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, সহস্রাধিক গুলি ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ১৯২টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ডিএমপি ৬৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২৬২টি গুলি উদ্ধার করে। এ সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংক্রান্ত মামলায় ৪১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাব ২০২৩ সালে সারা দেশ থেকে ৫৮১টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে। এ সময় ২৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে অনেক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উদ্ধার করা অস্ত্রের বেশির ভাগ বিদেশি। এসব অস্ত্র যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ অন্তত ৩০টি সীমান্ত পথে দেশে ঢুকছে। র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, অস্ত্রের বড় চালানগুলো দেশে ঢোকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে।

বিজিবির গোয়েন্দা তথ্য বলছে, দেশের সীমান্তগুলোর অন্তত ৩২টি স্থান দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে।

LEAVE A REPLY