পাহারায় ইইউ যুদ্ধজাহাজ

সোমালিয়া উপকূলে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নেভাল ফোর্সের ‘অপারেশন আটলান্টা’র একটি যুদ্ধজাহাজ। এছাড়া দস্যুকবলিত জাহাজটির ওপর টহল দিচ্ছে হেলিকপ্টার। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এক্সে (টুইটার) পোস্ট করা ইইউ নেভাল ফোর্সের কিছু ছবি থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সাগরে জলদস্যু দমন ও জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে সংস্থাটি অপারেশন আটলান্টা নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

ওই পোস্টে তিনটি ছবি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরের শেষদিক থেকে পশ্চিম ভারত মহাসাগরে দস্যুতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ১২ মার্চ দখলে নেওয়া এমভি আবদুল্লাহ এখনো জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

গত সপ্তাহে সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ উদ্ধার ও নাবিকদের মুক্ত করে ভারতীয় নৌবাহিনী। আটক করা হয় ওই জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুকে। অভিযানের ফলে প্রায় তিন মাস পর জাহাজটি জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়। এমভি রুয়েনে সফল অভিযানের পর আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের কব্জায় থাকা এমভি আবদুল্লাহতেও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে বলে আন্তর্জাতিক একটি বার্তা সংস্থার বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে জাহাজের মালিকপক্ষ অভিযানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। মালিকপক্ষ তখন বলেছিল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের মুক্ত করতে চায়। এদিকে জাহাজটিতে জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যরাও অভিযানের পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেন।

গত বুধবার জলদস্যুরা তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রথমবারের মতো যোগাযোগ করে। মালিকপক্ষ এখনো সেই তৃতীয় পক্ষটির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, জলদস্যুরা জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে পণ চাইতে পারে।

দস্যুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরুর দুই দিনের মাথায় এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি ইইউ নেভাল ফোর্সের যুদ্ধজাহাজের তৎপরতার তথ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নেভাল ফোর্স কি দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে, নাকি মুক্তিপণের বিনিময়ে হবে সংকটের চূড়ান্ত ফয়সালা-এ নিয়ে দেখা দিয়েছে কৌতূহল। তবে শিপিংসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জাহাজটি যেহেতু সোমালিয়ার জলসীমায় রয়েছে, তাই অভিযান চালাতে হলে সেই দেশের অনুমতি লাগবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিরও প্রয়োজন হবে।

এক্স হ্যান্ডেলে ইইউ নেভাল ফোর্সের পোস্ট করা তিনটি ছবির একটিতে দেখা যায়, এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ। ওই জাহাজ থেকে সোমালি উপকূলে নোঙর করে রাখা একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। দুজন নৌসেনা জাহাজটির দিকে নজর রাখছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নোঙর করা জাহাজটি এমভি আবদুল্লাহ। অপর ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এমভি আবদুল্লাহর ওপর টহল দিচ্ছে একটি হেলিকপ্টার।

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে সোমালিয়ার প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর থেকে চট্টগ্রামের কবীর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি দখলে নেয় একদল সশস্ত্র জলদস্যু। তারা জাহাজটিকে প্রথমে সোমালিয়ার গারাকাড উপকূলে নিয়ে যায়। পরে আরও প্রায় ৫০ মাইল দূরে গদবজিরান উপকূলসংলগ্ন এলাকায় স্থানান্তর করে। জাহাজটি বর্তমানে গদবজিরান থেকে দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে। এতে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন। তাদের সবাই বাংলাদেশি। জলদস্যুরা তাদের জিম্মি করে রেখেছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এমভি আবদুল্লাহ সোমালি উপকূলের কাছাকাছি রয়েছে। সেখানে জলদস্যুদের শক্ত ঘাঁটি। এ অবস্থায় অভিযানের চেয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই জিম্মি সংকটের সমাধান সহজ হবে। এর আগে যেসব দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে, তার ৯৯ শতাংশেরও বেশি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে।

তিনি বলেন, যে কোনো দেশের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে অভিযান চালাতে হলে সেই দেশের অনুমতি লাগে। এছাড়া এমভি আবদুল্লাহ যেহেতু বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ, তাই বাংলাদেশ সরকারেরও অনুমতি নিতে হবে।

জলদস্যুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কোন পর্যায়ে রয়েছে-জানতে চাইলে এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আলাপ-আলোচনা চলছে। আলাপ-আলোচনা ছাড়া তো এ সমস্যা থেকে বের হওয়া যাবে না। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।

এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি ইইউ নেভাল ফোর্সের যুদ্ধজাহাজের অবস্থানের কোনো তথ্য তার কাছে নেই জানিয়ে মেহেরুল বলেন, জাহাজের নাবিকরা ভালো আছে। তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি যে সুবিধা দেবে : এদিকে যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি জিম্মি মুক্তিতে প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করেন মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনাম চৌধুরী। প্রথমত, এত কাছে ইউরোপিয়ান বাহিনীর মতো শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি দস্যুদের ওপর একটা চাপ তৈরি করবে। যা সমঝোতার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব আফ্রিকার ওই উপকূল থেকে নতুন কোনো দস্যুদল সাগরে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে দস্যুদের তৎপরতা কমে আসবে।

চার মাসে ২৪টি ঘটনা : আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের দাবি, লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের হামলা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী বেশি সক্রিয় থাকায় ভারত মহাসগরসহ সোমালিয়া উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছুটা শিথিলতা দেখা দিয়েছে। আর এই সুযোগে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সোমালি জলদস্যুরা। এডেন উপসাগর তথা সোমালি বেসিনে গত বছরের ২৪ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্যিক জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানে ২৪টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে দস্যুতা, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। বৃহস্পতিবার অপারেশন আটলান্টার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

LEAVE A REPLY