এবার শুষ্ক মৌসুমে ডেঙ্গুর দ্বিগুণ গতি

প্রতীকী ছবি

দেশে চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এতে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেরি না করে এখনই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হয়ে ডেঙ্গু মশা জন্মানোর স্থান ধ্বংস করতে হবে। এ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।

জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় বছরের শুষ্ক মৌসুম। সাধারণত দেশে এ সময়ে বৃষ্টিপাত না থাকায় মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থাকে না বললেই চলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে তুলনায় এ বছর প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষ। গত বছরের তুলনায় এ হার দ্বিগুণের বেশি।

অন্যান্য বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দাঁড়ায় কয়েক গুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬৭৩ জন। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে ভর্তি ছিল ৮৪৩ জন। ২০২২ সালে ছিল ১৬৬ জন, ২০২১ সালে ৫৪ জন, ২০২০ সালে ২৭১ জন, ২০১৯ সালে ৭৩ জন, ২০১৮ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ছিল ১৮৬ জন, ২০১৬ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে দুজন ও ২০১৪ সালে ছিল ২৪ জন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু বছরব্যাপী থাকলেও বিগত বছরগুলোতে আক্রান্তের চিত্র সবচেয়ে ওপরের দিকে থাকতে দেখা গেছে জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে।

রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন, বছরের শুরুতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।

এপ্রিল থেকে সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি মার্চ থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এপ্রিল থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে শুরু করবে। আগস্টে আক্রান্তের হার চরমে পৌঁছবে।

ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা এমনিতেই বাড়তি। এর মধ্যে যত বৃষ্টিপাত হবে, যত আর্দ্রতা বাড়বে, এডিস মশার প্রজনন তত বাড়বে। এডিসের জন্য আমরা সারা বছর একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছি, যে কারণে বছরব্যাপী ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এখন এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেইসমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি রয়েছে। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।’

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জনসম্পৃক্ততা খুব জরুরি। সমাজসেবামূলক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন—সবাইকে কাজ করতে হবে। বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানিতে যেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে, সেই পানি ফেলে দিতে হবে। এই দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিককে নিতে হবে।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ পাচ্ছে, এতে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী যা ছিল, ২০২৩ সালে এসে হয়েছে কয়েক গুণ। আবার ২০২৩ সালের তুলনায় চলতি বছরে প্রথম তিন মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু দ্বিগুণ হারে বাড়ছে।

তিনি বলেন, এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে যদি বিগত বছরের আবহাওয়া ও পরিবেশের উপাদানগুলোর তুলনা করা যায়, তাহলে সেখানেও একটা হোঁচট খেতে হবে। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর তাপমাত্রা এখন পর্যন্ত নিম্নগামী, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য প্রতিকূল। এর পরও যদি এ ভয়াবহ পরিণতি হয়, তাহলে বুঝতেই পারছেন, ২০২৪ সালের পরের দিনগুলোয় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে।

তিন কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না

ড. গোলাম সারোয়ার বলেন, প্রধান তিন কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এক. গবেষকের অভাব; দুই. গবেষণাগার নেই; তিন. গবেষণা হচ্ছে না। সহজভাবে বলতে গেলে, মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গবেষণার মধ্য দিয়ে হতে হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। যেমন—একজন মশক নিধন কর্মী জানেন না কতটা গতিতে তিনি কীটনাশক স্প্রে করবেন, দূরত্ব কতটুকু হবে ও ড্রপ সাইজ কেমন হবে। এসব বিষয়ে জানতে গবেষণা জরুরি। আর তা না হলে মশা মরবে না, বরং রেজিস্ট্যান্স হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ জন্য প্রয়োজন গবেষণা। গবেষণার মধ্য দিয়ে জানা যাবে কতটুকু পরিমাণ রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে, কোন ইনসেক্টিসাইড কতটুকু রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে, কোনটা কতটুকু কাজ করছে। এটি না করে শুধু কোটি কোটি টাকার ওষুধ ছিটিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

ঢাকার বাইরে ৬৬% ডেঙ্গু রোগী

মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে গত এক দিনে আরো চারজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। নতুন রোগীদের নিয়ে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছে ৬৩ জন। গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩৪ শতাংশ রোগী ঢাকা মহানগরের ও ঢাকার বাইরের ৬৬ শতাংশ। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বড়গুনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই, অভাব রয়েছে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার এবং প্রশিক্ষিত লোকের। তাই এখন থেকেই কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার প্রশিক্ষণ দিয়ে কীটতত্ত্ববিদ বাড়ানো প্রয়োজন। মশা নিয়ন্ত্রণে একটি কারিগরি কমিটি গঠন, ওয়ার্ডভিত্তিক ডেঙ্গু জরিপ করতে হবে। ল্যাব বাড়াতে হবে।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় সমাধান কিছুটা সহজ হলেও ঢাকার বাইরে সমাধান অনেক কঠিন। কারণ সেখানে সক্ষমতার অনেক অভাব। এর সমাধান কিভাবে হবে, এটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ জন্য আমি বারবার বলেছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি এর দায়িত্ব নেয় এবং সারা দেশে যদি এডিস মশা নিয়ে কাজ করতে পারে, তাহলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।’

গত শতাব্দীর ৬০ দশকে এই ভূখণ্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সে সময় একে ‘ঢাকা ফিভার’ নাম দেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে গত বছর। সে বছর আক্রান্ত হয় তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ও মৃত্যু হয় এক হাজার ৭০৫ জনের। এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রথমবার এক লাখ ছাড়ায়; সে বছর ভর্তি হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন, মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।

LEAVE A REPLY