বিকাশ-নগদ এজেন্টদের লাখ লাখ টাকা যেভাবে হাতিয়ে নেয় তারা

প্রথমে বিকাশ বা নগদের এসআরদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতো তারা। এরপর সেই এসআরদের কাছ থেকে নতুন এজেন্টদের নম্বরের তালিকা হাতিয়ে নিত। গত ২ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬০-৭০ জন বিকাশ-নগদ এজেন্ট ব্যবসায়ীকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। স্বল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার লোভে এবং মাদক সেবনের অর্থ জোগাতে এ প্রতারণার আশ্রয় নেয় তারা। পৃথক অভিযানে এমনই দুটি চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ও ফরিদপুর জেলায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে র্যাব-১০।

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে সাধারণ মানুষের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রধানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। চক্রের সদস্যরা হলো-মূল হোতা ইসমাইল মাতুব্বর, ইব্রাহিম মাতুব্বর, মানিক ওরফে মতিউর রহমান ও সিনবাদ হোসেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩৫টি সিম কার্ড, ৫টি মোবাইলের চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ব্যাগ ও নগদ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় অভিযান চালিয়ে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের গ্রেফতার পাঁচ সদস্য হলো- সুমন ইসলাম, মাহমুদুল হাসান পলক, সাব্বির খন্দকার, সাকিব ও রাসেল তালুকদার। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি মোবাইল ফোন, ৯১টি সিম কার্ড, ১টি ব্যাগ, ১০৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট ও নগদ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।

বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন।

তিনি জানান, সখ্য গড়ে তোলার পর চক্রটি বিকাশ বা নগদের এসআরদের কাছ থেকে এজেন্টদের নম্বরের তালিকা হাতিয়ে নিত। এরপর এসআর সেজে তারা নতুন কোনও এজেন্টের নম্বরে কল করত। বলত আমি বিকাশ বা নগদের এসআর। আপনি তো শুধু টাকা পাঠান, নতুন কিছু সেবা যুক্ত করে নিলে লাভ বেশি পাবেন। তাদের এমন কথা শুনে দোকানি এজেন্ট বলতো, ঠিক আছে তাহলে সেট করে দেন। দোকানি অবিশ্বাস করলে বিকাশের এসআরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলত। এরই মধ্যে এসআরের নম্বর ক্লোন করে সেই এজেন্টকে ফোন দিতো। বলতো আমাদের সিনিয়র স্যার আপনাকে হয়তো ফোন দিয়েছিল, আপনি তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। এবার এজেন্ট দোকানির বিশ্বাস জন্মে। পরে তাকে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ফোন দিলে তারা যেভাবে তথ্য চায় সেভাবে তথ্য দেয়; কিন্তু এর মধ্যেই হাতিয়ে নেওয়া হয় সেই এজেন্টের গোপন পিন নম্বর। তার অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পরবর্তীতে যত টাকা ঢুকে সবটাই হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

যেভাবে এজেন্টকে বোকা বানায় প্রতারকরা

র‌্যাব-১০ অধিনায়ক জানান, চক্রটির মূল হোতা সুমন ইসলাম। তার নেতৃত্বে চক্রটি প্রায় ৮-৯ মাস ধরে অনেক বিকাশ-নগদ এজেন্টের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধ উপায়ে নতুন এজেন্টদের নম্বর সংগ্রহ করত। সুমন প্রথমে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে বিকাশ-নগদের প্রতিনিধিদের নম্বর ক্লোন করে করত। এরপর এজেন্টদের ফোন দিয়ে নিজেকে প্রতিনিধির পরিচয় দিত। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০টি নম্বরে কল দিত। বিকাশ-নগদ এজেন্টদের হাজারে ৪ টাকার পরিবর্তে ৮-১০ টাকা লাভের বিভিন্ন অফার সম্পর্কে বলত। এক্ষেত্রে এজেন্টরা সেই অফার সম্পর্কে অবগত নয় বললে সুমন তাদের এসআরের ফোন নম্বর নিয়ে ক্লোন করে ওই নম্বর হতে এজেন্টদের ফোন করে সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভের (এসআর) পরিচয় দিয়ে বলতো উনি আমাদের বস, উনি যা বলেন সেভাবে কাজ করেন। এরপর ফোন কেটে দিত।

তিনি জানান, সুমন মোবাইলে ওটিপি পাঠানোর মাধ্যমে কৌশলে এজেন্টদের কাছ থেকে এজেন্ট নম্বরের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করত। একইভাবে একাধিক ভিকটিমের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ-নগদ অ্যাপস ডাউনলোড এবং সব অ্যাকাউন্টে লগইন করে রাখত। সেই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা প্রবেশ করামাত্রই সুমন মোবাইলে নটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতো এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই টাকা তার অন্য সহযোগী মাহমুদুল, সাব্বির, সাকিব ও রাসেলের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করত। পরবর্তীতে রাসেল সেই টাকা তাদের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্যাশ আউট করে সুমনের কাছে নিয়ে আসত। সেই টাকা তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত।

গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানায় র‌্যাব।

LEAVE A REPLY