মুস্তাফিজ কার?

সংগৃহীত ছবি

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) কেন দেশটির মূলধারার ক্রিকেটারদের ভিনদেশের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে খেলতে দেয় না? এই ‘মূলধারা’ বাংলাদেশের মতো শুধু জাতীয় দলে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের প্রথম শ্রেণির সব ক্রিকেটারের বেলায়ই নিয়মটি প্রযোজ্য। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না। এমনকি রোহিত শর্মার জন্যও এই নিয়ম শিথিল হয় না। উল্টো ভারতী

এমনকি রোহিত শর্মার জন্যও এই নিয়ম শিথিল হয় না। উল্টো ভারতীয় বোর্ডের সচিব জয় শাহ সম্প্রতি ‘গরম’ দিয়েছেন ভারতের মহাতারকাদেরও।

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশটির প্রথম শ্রেণির আসর রনজি খেলতে গড়িমসি করলে জাতীয় দলের দরজা বন্ধ করে দেবে বিসিসিআই। এমনকি আইপিএলের প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকেও ছেঁটে ফেলা হবে।

অবিশ্বাস্য! জয় শাহ প্রভূত ক্ষমতাবান। তবু সরকারিভাবে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিদের এমন হুমকি দিতে ক্ষমতার শক্তির চেয়েও বেশি কিছু লাগে।

জয় শাহ সেটি অর্জন করেছেন। তা ছাড়া ভারতের ক্রিকেট বিবর্তিত হয়ে এমন এক উচ্চতায় উঠে গেছে, যেখানে পেশাদারির চর্চাই শেষ কথা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট না খেলার কারণে ছাঁটাই হলে বিরাট কোহলির সমর্থকরাও সম্ভবত জয় শাহ বিরোধী স্লোগান তুলবে না। দিনশেষে দেশের স্বার্থ আগে।

অবশ্য আধুনিক ক্রিকেটে জাতীয় দলে খেলার জন্য জাতীয় স্বার্থ কিংবা দেশপ্রেমের মতো আবেগ না থাকলেও চলে। ক্রিকেটে অর্থের যে ঝনঝনানি, তাতে চাকরিসূত্রেই ক্রিকেটারের ওপর কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরানো যায়। সেই সূত্রেই নিয়ম ভঙ্গ করলে বিরাটকে ‘বেকার’ বানিয়ে দেওয়ার পরোক্ষ হুমকি দিতে পারেন জয় শাহ, যা ভারতের ক্রিকেট সমর্থক সমাজকেও আশ্বস্ত করে।
সেই আশ্বাসটা কিসের? নামি তারকাদের রনজিতে খেলতে বাধ্য করার পেছনে ভারতীয় বোর্ডের সদিচ্ছা স্পষ্ট—একাধারে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানো এবং সবাইকে টেস্টের জন্য প্রস্তুত রাখা। জাতীয় স্বার্থকেই এখানে অগ্রাধিকার দিয়েছেন জয় শাহ।


ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট নিয়ে ভারতের নিষেধাজ্ঞারও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। ক্রিকেটের ‘মেগা শো’ আইপিএল আয়োজক বিসিসিআইয়ের তরফে রোহিত শর্মাদের জন্য বার্তাটা স্পষ্ট— কেন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছোটাছুটি করে টুটাফাটা লিগ খেলবে? বরং ওই সময়টায় বিশ্রাম নাও। এরপর ঘরোয়া নয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি হও।
আইপিএল আয়োজক ভারতীয় বোর্ড ক্রিকেটবিশ্বেই মহা দাপুটে। পরোক্ষে ক্রিকেটবিশ্বের লাগাম বিসিসিআইয়ের মুঠোয়। এর আদর্শ নমুনা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটসূচি নির্ধারণের সময় আইপিএল বাস্তবতা মেনে নিতে হয় খোদ বৈশ্বিক ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে, যা এখন ছাইচাপা ক্ষোভ হয়ে আছে। যদিও তা আর কোনো দিন প্রকাশ্য হবে বলে মনে হয় না। এর মূল কারণ সম্ভবত অর্থনীতির পাশাপাশি ভারতের ক্রিকেটের মানেরও শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি। এবারের আইপিএল ‘দানবীয়’ ক্রিকেট তার একটি নমুনা।

আর বাংলাদেশ? ছুটি বাড়িয়ে মুস্তাফিজুর রহমানকে আইপিএল খেলতে দেওয়া উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) ভিন্নমত রয়েছে। বিসিবি পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের অভিমত হলো, আইপিএলে আরো বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ দিলে মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং আরো ক্ষুরধার হবে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজের চেয়ে আইপিএল খেলাটা নাকি বাঁহাতি এই পেসারের জন্য ভালো হবে! গতকাল অবশ্য ক্রিকেট প্রশাসনে মুস্তাফিজের প্রত্যক্ষ অভিভাবক, ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস এই যুক্তি খণ্ডন করেছেন। জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে মুস্তাফিজকে এক দিনের বেশি বাড়তি ছুটি দেওয়া হয়নি। জিম্বাবুয়ে সিরিজে মুস্তাফিজকে বাংলাদেশের দরকার। সে অনুযায়ী ১ মে চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচটি খেলেই দেশে ফেরার কথা তাঁর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের পর সুযোগ থাকলেও মুস্তাফিজকে আইপিএলের বাকি অংশে খেলতে  ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেবে না বিসিবি। অবশ্য পরের অংশের সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে পাল্টে যায় কি না, সেটি সময়ই বলবে। কারণ মুস্তাফিজের আইপিএল-দীক্ষার পক্ষে বোর্ডের ভিন্নমতের কথা তো একজন পরিচালক নিজেই বলেছেন।

ক্রিকেট শক্তিতে পার্থক্য আছে। আরো বড় পার্থক্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসকদের চিন্তায়ও। জয় শাহ ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দেন। আর বিসিবির একজন পরিচালক জাতীয় দলের ক্রিকেটারের পক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে ছুটির পক্ষে মতামত দেন অদ্ভুত যুক্তিতে। মুস্তাফিজ তরুণ কোনো ক্রিকেটার হলে ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছে ২০১৫ সালে। এ নিয়ে সপ্তম আইপিএল মৌসুম খেলছেন মুস্তাফিজ। তাহলে আইপিএল থেকে মুস্তাফিজের আর নতুন কী শেখার আছে? সেই শিক্ষাও নিতে হবে জাতীয় দলের দায়িত্ব ফেলে! মুস্তাফিজ তো বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের বেতনভুক্ত খেলোয়াড়। বাংলাদেশের জার্সিতে ম্যাচ খেলা তাঁর প্রধানতম দায়িত্ব। অথচ আকরাম, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বিসিবির পরিচালক সেই দায়িত্ব পালনের চেয়ে মুস্তাফিজের জন্য চেন্নাই সুপার কিংসের সুরে কথা বলছেন!

যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকরাম খানের এই বক্তব্যের পক্ষে জনসমর্থন মিলেছে। তবে সেই সমর্থকরাই বিগড়ে যাবে যদি দেখা যায় যে, আইপিএল খেলে পরিশ্রান্ত মুস্তাফিজকে মলিন দেখাচ্ছে লাল-সবুজ জার্সিতে। বিদেশি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে মুস্তাফিজের চোটগ্রস্ত হওয়ার উদাহরণ আছে। মাস দেড়েক পর অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে তেমন কিছুর আশঙ্কা থেকেও মুস্তাফিজকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি। আশার কথা, সে রকম সিদ্ধান্তই গতকাল নিশ্চিত করেছেন জালাল ইউনুস। যদিও পূর্বনির্ধারিত ছুটি এক দিন বাড়ানোও চুক্তিবদ্ধ কারোর জন্য বিশেষ সুবিধাই।

একবার আপনি নিজে ভেবে দেখুন। ধরুন, আপনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। সেই প্রতিষ্ঠান কি আপনাকে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্টে’র জন্য ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে দেবে? এই স্কিল ডেভেলপমেন্টও আদতে লোক-দেখানো একটি যুক্তি। বিশেষ করে মুস্তাফিজুর রহমানের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে। আইপিএল খেলে সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া তো আগেই সম্পন্ন করেছেন তিনি। তাঁর আর নতুন কী শেখার আছে? এত দিনে জাতীয় দলের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা মুস্তাফিজের। কিন্তু সেখানে উল্টো অন্যদের ছায়ায় আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। কেন?

এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে গিয়ে কালের কণ্ঠকে উদ্বেগজনক একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই ভালোভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে পারছে বলেই হয়ত বোলিংয়ে মুস্তাফিজ ধার ফিরে পেয়েছেন। তার মানে, বাংলাদেশ দলের এত এত কোচিং স্টাফ, অধিনায়ক কিংবা বোর্ড কি মুস্তাফিজের সেরা নৈপুণ্য বের করে আনতে ব্যর্থ? আসলে এসব যুক্তি অসার। অন্য একটি কারণ নিয়ে কানাঘুষা আছে। যেমন, আইপিএলে দল পাওয়া মানে লটারি জেতা। বিস্তর টাকা। জাতীয় স্বার্থে সেখানে অনিয়মিত হয়ে পড়লে আবার লটারি হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি আছে। এই আর্থিক লাভ ছাড়া আইপিএল থেকে পরিণত মুস্তাফিজের আর কোনো অর্জনের সম্ভাবনা নেই।

বরং দুর্ভাবনা আছে। সেই দুর্ভাবনা ফিটনেসকে ঘিরে। সেটা শুধু মুস্তাফিজকে ঘিরে নয়, উত্তর আমেরিকায় অনুষ্ঠেয় এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ই এ নিয়ে জোর আলোচনা উঠবে। আইপিএল শেষ হবে বিশ্বকাপের পাঁচ দিন আগে। আড়াই মাস মাঠে নিংড়ে দেওয়া ক্রিকেটার কি ভারত থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপে শতভাগ দিতে পারবেন? তারও আগে, আইপিএলের ধকল পেরিয়ে পুরো ফিট কি থাকবেন ক্রিকেটাররা? গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বেশ ঘটা করে আইপিএল-ক্লান্তি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। এবারও হবে। বলাবলি হবে, আইপিএল খেলেই শরীরটা শেষ করে দিল!

যদিও সূচি আর বদলাবে না। আইপিএল তার নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বিশ্বকাপে দেখা যাবে অর্ধেক ফিট ক্রিকেটারদের ছড়াছড়ি। অতঃপর ‘নাটের গুরু’ ধরে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে তুলাধোনা করা হবে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো লাভ হবে না। সেই তিমিরেই থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। জাতীয় দল না আইপিএল—এই বিতর্কের ঝড় উঠবে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। কিন্তু ঝুলে থাকবে প্রশ্নটি—মুস্তাফিজ কার? অবশ্য বর্তমানে মুস্তাফিজ একটি নাম শুধু। অতীতেও জাতীয় দল বনাম আইপিএল ঝড় উঠেছে বাংলাদেশে। সেই ঝড়ে কারো স্বপ্ন উড়ে গেছে, কেউ-বা উড়ে গেছেন ভারতে আইপিএল খেলতে। মুস্তাফিজকে নিয়ে এবারের ভিন্নমতের বিসিবির সেই নীতি ছিল দ্বিমুখী।

LEAVE A REPLY