প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস দেশ, তিনজনের মৃত্যু

প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে দেশবাসী। গতকাল শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত এটাই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। প্রচণ্ড গরম ও হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা, পাবনা ও গাজীপুরে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

দেশের দুটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। চট্টগ্রাম ও সিলেট ছাড়া অন্যান্য বিভাগের বেশির ভাগ জেলার ওপর দিয়ে বইছে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শিগগিরই এই অসহনীয় গরম থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আজ রবিবারও দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।

বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় গরমে বেশি অস্বস্তিকর লাগার অনুভূতিও বহাল থাকবে। বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা না থাকায় মাসের বাকি দিনগুলোতেও তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ মো. শাহীনুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাধারণত এই সময় গরম বাতাস ভারতের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভারতের পশ্চিমের রাজ্যগুলো এবং আমাদের এখানে বড় পরিসরে বৃষ্টি না হলে তাপমাত্রার তেমন একটা পরিবর্তন হবে না।

বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হচ্ছে এই মাসে। আগামী এক সপ্তাহ পরিস্থিতি কমবেশি একই রকম থাকতে পারে।’

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টিও হতে পারে। আগামী দুই দিন ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৭ ডিগ্রি বেশি

গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে, ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই এখন পর্যন্ত এই মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে গত শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১.৫ ডিগ্রি। ঢাকায়ও গতকাল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (রাজধানীতে) ৪০.৪ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়।

গতকাল সারা দেশে অঞ্চলভেদে দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৭ ডিগ্রির বেশি ছিল। যশোর ও ঢাকায় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ ডিগ্রি বেশি। আগের দিনের তুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ০.৫ থেকে ১ ডিগ্রি বেড়েছে। 

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। চুয়াডাঙ্গা টানা কয়েক দিন ধরেই সর্বোচ্চ মাত্রার তাপে ধুঁকছে। রাজশাহী ও পাবনা জেলাসহ খুলনা বিভাগের বাকি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের সব জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফেনী, কক্সবাজার, চাঁদপুর ও রাঙামাটি জেলাসহ রাজশাহী বিভাগের বাকি জেলা ও বরিশাল বিভাগের সব জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। আজ রবিবারও এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭.৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা মৃদু তাপপ্রবাহ। ৩৮ থেকে ৩৯.৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪১.৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। ৪২ ডিগ্রি বা এর বেশি তাপমাত্রা হলে তখন তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

প্রকৃত তাপের চেয়ে গরম লাগছে বেশি

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমানে দিনের তাপমাত্রার চেয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত তাপমাত্রা অন্তত কয়েক ডিগ্রি বেশি। বিষয়টি কালের কণ্ঠের কাছে ব্যাখ্যা করে আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, মূলত জলীয় বাষ্প ও বাতাসের কম গতিবেগের কারণে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে।

তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চলে তা কিছুটা কম। সে জন্য উপকূলীয় এলাকায় প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে। ঢাকায়ও বিকেল ৩টার পর জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ও গরমের অনুভূতি উভয়ই বাড়তে থাকে।

আবুল কালাম মল্লিক বলেন, প্রকৃত তাপমাত্রা বেশি থাকা সত্ত্বেও বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকলে অনুভূত তাপমাত্রা অনেকটা কমে যায়। বর্তমানে বাতাসের গতিবেগ খুব কম। সুতরাং গরমের অনুভূতির তীব্রতা দুপুর ১২টার পর থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

এপ্রিলের এই তাপমাত্রা কতটা অস্বাভাবিক

এপ্রিলের বর্তমান তাপ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলছেন দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এপ্রিল মাস বিবেচনায় এই তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহ স্বাভাবিক। তবে চলমান পরিস্থিতির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল ও আওতাধীন এলাকা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। আগে তাপপ্রবাহ মূলত দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বেশি থাকলেও এখন তা মোটামুটি সারা দেশেই দেখা যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘যা হচ্ছে তা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। চৈত্রের শেষে বা বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ রকম গরম বা তাপমাত্রা থাকতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘বাতাসের দিক পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। এই বছর গত বছরের মতো মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, ভারতের দক্ষিণ অংশ ও বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশে গরম বাতাস আসছে। ফলে আমরা এখন বাতাসে আগুনের হল্কা টের পাচ্ছি। আগে এই বাতাসটা ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যেত।’

গরমে জীবন অতিষ্ঠ, তিনজনের মৃত্যু

তীব্র গরমে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা, পাবনা ও গাজীপুরে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল গতকাল। গতকাল সকালে দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী ঠাকুরপুর গ্রামে জাকির হোসেন নামের এক যুবক মারা গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। জেলায় সকাল ৯টার পর থেকেই রোদের তাপ অসহনীয় হয়ে উঠছে।

গতকাল পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা জেলায় চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ। পাবনা শহরে হিট স্ট্রোকে একজন মারা গেছেন। মৃত সুকুমার দাস (৬০) পাবনা শহরের শালগাড়িয়া জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. জাহিদুল ইসলাম হিট স্ট্রোকে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। কোনাবাড়ী থানার ওসি কে এম আশরাফ উদ্দিন জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ওই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। শনিবার বিকেলে তাঁর লাশ উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। মৃত সোহেল রানা (৩৫) গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুরের এনায়েতপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে।

যশোরেও তীব্র তাপপ্রবাহে স্থবির জনজীবন। বিকেল ৫টার সময়ও দেখা গেছে শহরের ব্যস্ত সড়কে ভিড় বা যানজট নেই। হাসপাতালগুলোতে শিশু রোগীদের চাপ বেড়েছে।

শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুস সালাম জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বেশির ভাগ শিশু ঠাণ্ডা জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি শিশুদের বেশি করে তরল খাবার ও পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।

উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে গতকাল তাপমাত্রা ৪১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। টানা কয়েক দিনের তাপপ্রবাহে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল গ্রামের মানুষের মধ্যে হাঁসফাঁস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা সদরের ভ্যানচালক মালেক বলেন, ‘রোইদের তেজে থাহা যায় না। এবা গরম জীবনেও দেহি নাই।’

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা), পাবনা, যশোর, বেনাপোল, বাগেরহাট, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি এবং নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর)

LEAVE A REPLY