ফাইন্যান্স কোম্পানির অবস্থা খুবই নাজুক

দেশে কার্যরত ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে আগে সংঘটিত জাল-জালিয়াতির নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন আরও স্পষ্ট ও প্রকট হচ্ছে। এদের সার্বিক আর্থিক অবস্থা গড় হিসাবে খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আস্থার সংকটে পড়ে আমানত বাড়ার হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে

বা অন্য ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের আমানতের পরিমাণের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ কমে গেছে। মূলধন কমেছে খরস্রোতা গতিতে। খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লেগেছে ‘পাগলা ঘোড়া’র দৌড়। এসব মিলে কোম্পানিগুলোর সব সূচক নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। শুধু আমানত ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কমার হার সামান্য ইতিবাচক। তবে কয়েকটি ফাইন্যান্স কোম্পানি ভালো চলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনটি সোমবার রাতে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ব্যাংক খাত, সার্বিক অর্থনীতির পাশাপাশি ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর (আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নাম ছিল, এখন তা পরিবর্তন করে ফাইন্যান্স কোম্পানি করা হয়েছে) সার্বিক আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রতিবেদন বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এ খাতে মূলধন ছিল ১২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। জাল-জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ২০২০ সালে মূলধন কমে ১০ হাজার ৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। জালিয়াতির প্রভাব আরও প্রকট হলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মূলধন আরও কমে ৭ হাজার ১৩২ কোটি টাকায় নামে।

২০২২ সালের মার্চে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকায়। ওই সময়ে ভালো কয়েকটি কোম্পান রাইট শেয়ার ও বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন বৃদ্ধি করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বাড়ায় মূলধন আবার কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় নামে। ২০২৩ সালের মার্চে আরও কমে ৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, জুনে আরও কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকায় ও সেপ্টেম্বরে মূলধন রেকর্ড পরিমাণে কমে ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। মূলধন কমায় তাদের ঝুকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমেছে।

ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সম্পদ ও দেনার মধ্যকার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। আগে দেনার চেয়ে সম্পদ বেশি ছিল। এখন দেনার পরিমাণ বেশি। সম্পদ কমে গেছে। যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আরও অনেক কোম্পানির আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা নেই। জুনে দেনার চেয়ে সম্পদ সামান্য বেশি ছিল। সেপ্টেম্বরে সম্পদ কমেছে, দেনা বেড়েছে। ফলে দায় সম্পদের অনুপাত ১০০ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা ৪২ পয়সা দেনার বিপরীতে সম্পদ আছে ১০০ টাকা।

মূলধন পর্যাপ্ততা কমতে কমতে এখন তলানিতে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। জুনে তা অর্ধেক কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ০৮ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

গড়ে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সম্পদ ও মূলধন থেকে আয় কমতে কমতে এখন লোকসানের মুখে দাঁড়িয়েছে। লোকসানের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। সম্পদ থেকে সর্বশেষ আয় হয়েছিল ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর থেকে আর কোনো আয় হয়নি। আয় নেতিবাচক বা লোকসান হচ্ছে। ২০২০ সালে লোকসান হয়েছিল দশমিক ১৯ শতাংশ, ২০২১ সালে হয় দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে লোকসানের হার আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ০২ শতাংশ।

একই সঙ্গে মূলধন থেকেও সর্বশেষ আয় হয়েছিল ২০১৯ সালে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে তা আয়ের পরিবর্তে লোকসান হয় ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০২১ সালে লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭৯ শতাংশে। ২০২২ সালে লোকসান আরও বেড়ে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশে ওঠে। জুনে তা আরও বেড়ে ১০৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ মূলধন বিনিয়োগের চেয়ে লোকসানের অঙ্ক বেশি। অব্যাহতভাবে কোম্পানিগুলো লোকসান দেওয়ায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে।

২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে বেড়ে হয় ১০ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ২০ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে।

গড় হিসাবে কোম্পানিগুলোর সম্পদের পরিমাণ কমছে। জুনে সম্পদ ছিল ৯৯ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৯২৭ কোটি টাকায়।

ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর ব্যবসার জন্য তহবিলের প্রধান উৎস চারটি। এগুলো হচ্ছে-ধার, আমানত, মূলধন ও অন্যান্য উৎস্য। এর মধ্যে জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংক বা অন্য কোম্পানি থেকে ধারের স্থিতি ২৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা থেকে কমে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি দাঁড়ায় দাঁড়িয়েছে। আস্থার সংকটে তাদের এখন আর কেউ নতুন করে ধার দিতে চাচ্ছে না। বরং দুর্বল কোম্পানি থেকে আগে দেওয়া ধার তুলে নিচ্ছে।

জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়েছে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা। আগে আমানত কমছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বাড়ছে। তবে এ হার অত্যন্ত নগণ্য। মূলধন থেকে বিনিয়োগের তহবিলের জোগান কমেছে। জুনে মূলধন ছিল ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৪১৬ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। ফলে এখন মূলধন থেকে আর কোনো নতুন বিনিয়োগ বা ঋণ দিতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো বাধ্য হয়ে অন্যান্য খাত থেকে তহবিল সংগ্রহ করছে। জুনে এ খাতে সংগৃীত তহবিলের স্থিতি ছিল ২২ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ২৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল কোম্পানি থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। ফলে সরকারি আমানত কমে যাচ্ছে। জুনে সরকারি আমানত ছিল ৪৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৪২ কোটি টাকা হয়েছে। আগে ৬০ কোটি টাকার বেশি ছিল সরকারি আমানত।

কোম্পানিগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কিছুটা কমেছে। গত বছরের মার্চে ছিল ৭০ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ফলে ভালো কোম্পানিগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষার হার বাড়িয়েছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কিছুটা কমেছে।

LEAVE A REPLY