মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ছে

দেশে নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মজুরি বা আয় বাড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে ডলারের দামের আকস্মিক উচ্চলাফে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতির চাপে নতুন করে আরও কয়েক লাখ মানুষ দরিদ্র বা অতিদরিদ্রের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। এতে অর্থনৈতিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধিরও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। উচ্চ আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নানামুখী সংকটের সম্মুখীন হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমবে।

এদিকে উচ্চলাফে ডলারের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম সরকারের পুরোপুরি হাতছাড়া হবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদরা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারত ও শ্রীলংকাসহ যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, তারা একে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে ডলারের মানে নতুন করে টাকার বড় ধরণের অবমূল্যায়ন হওয়ায় মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শুধু সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে হুন্ডির কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাহলে ডলারের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। তখন ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে অন্তত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে। এছাড়া সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে যারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমদানি-রপ্তানির নামে যেসব টাকা পাচার করা হয়, সেগুলো বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। এতে পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা আসবে। তখন মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

তবে দ্রম্নত এ সংকটের সমাধান হবে এমনটা আশা করছেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে শুল্ক বৃদ্ধিসহ সব আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। যা মুদ্রাস্ফীতিকেও উসকে দেবে। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে আমদানির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এতদিন ডলারে দর ১১০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও ব্যাংকগুলো ১২০-২৩ টাকায় ক্রয় করেছে। এজন্য দেশে ডলারের মজুত বেড়েছে। কিন্তু এখন যদি ১১৬-১৮ টাকায় এটিকে আটকে রাখা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই ডলারের মজুতে টান পড়বে। অর্থাৎ কম দরে ডলার কিনতে শুরু করলে বৈধ পথে ডলার আসা কমে যাবে। ডলারের মজুতও কমে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হওয়ার পাশাপাশি ডলার বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

এদিকে হঠাৎ করে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়ায় পণ্য আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি কতটা উর্ধ্বমুখী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। এখানে যদি ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে মানুষের কষ্ট হবে এবং দেশে এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার। এই ব্যবসায়ী নেতার শঙ্কা, ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়ায় আমদানিতে সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক, পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবে আমদানিকারকরা।

ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১৭ টাকা হয়েছে- এটা গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ভালো সংবাদ। কিন্তু দেশের জন্য ভালো সংবাদ নয়। ডলারের দাম বাড়ার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং জনগণের ওপর চাপ বাড়বে। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বাড়বে। কিছু কিনতে গেলে বেশি দাম দিতে হবে; যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তার ভাষ্য, ডলারের দাম বাড়াটা আমদানিকারকদের জন্য ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠবে। সবশেষ ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকা ছিল। তখন এলসি খোলার জন্য আমদানিকারকদের ১২০-১২২ টাকা দরে ডলার কিনতে হয়েছে। এখন তা ১৩০ টাকায় গিয়ে ঠেকবে। ডলারের এই বাড়তি দাম সমন্বয় করতে গেলে পণ্যের দাম বাড়বে। যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে, সে দামে ডলার মিলবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন ওই ব্যবসায়ী।

এদিকে নতুন দরে কেনা ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা এখনও শুরু না হলেও এরই মধ্যে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রসাধনী পণ্যের দাম গত ২৪ ঘণ্টায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। যা কয়েকদিনে আরও অনেকটা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের কসমেটিক ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন জানান, ডলারের দাম বাড়ার খবরে চকবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা সব পণ্যের দামই বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। ব্যবসায়ীদের ধারণা, উচ্চদরের ডলারে আমদানিকৃত নতুন পণ্য বাজারে এলে সেগুলোর দাম বাড়বে। তাই দোকানে মজুতকৃত পণ্য তারা আস্তে-ধীরে বিক্রি করতে চাইছেন। কেউবা চড়া দরে পণ্য ছেড়ে দিচ্ছেন। খুচরা মার্কেটেও যে এর প্রভাব পড়েছে তা ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গুলশান মার্কেটে প্রসাধনী সামগ্রী কিনতে আসা শায়লা বেগম জানান, গত সপ্তাহে যে বিদেশি লোশন ১২শ’ টাকায় কিনেছেন, দোকানিরা এখন তার দাম দেড় হাজার টাকা চাইছেন। চার হাজার টাকার পারফিউমের দাম বেড়ে সাড়ে চার হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।

শুধু প্রসাধনী সামগ্রিই নয়, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত শিশু খাদ্যপণ্যের দামেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মালিবাগের বেবি ফুডস কর্নার নামের শিশু খাদ্যপণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আফজাল হোসেন জানান, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বিদেশি গুঁড়া দুধের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। তাই তারাও তাদের দোকানে মজুতকৃত বেবি ফুডস কিছুটা বুঝে-শুনে বিক্রি করছেন।

ওই ব্যবসায়ীরা ভাষ্য, উচ্চলাফে ডলারের দাম বাড়ায় নিঃসন্দেহে নতুন চালানে বিদেশ থেকে আনা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। এ সুযোগে অনেক ব্যবসায়ী এখনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ পণ্য মজুত করে সময় সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছেন।

এদিকে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দামও হু হু করে বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, ডলারের দর বাড়ায় তাদের বেশি দামে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের বাড়তি দরে পণ্য বিক্রি করতে হবে। এ সুযোগ কোনো কোনো আমদানিকারক ও মজুতদার তাদের আগের আমদানিকৃত পণ্য বাজারে ছাড়তে ঢিলেমি করবে। যাতে পরবর্তীতে বাজারে দর চড়লে তা তারা বেশি দামে বিক্রি করতে পারে।

বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ হয়েছে বলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি জরিপে উলেস্নখ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বাড়লে দেশে এক বেলা কম খাওয়া মানুষের সঙ্গে কয়েক গুণ বাড়বে বলে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন।

যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো বা বিবিএসের সবশেষ হিসাবে, গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ফেব্রম্নয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চ মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রম্নয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ এবং ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

LEAVE A REPLY