পরাধীনতার ৭৬ বছর পার করল গাজা

নাকবা দিবস। ফিলিস্তিনিদের জন্য ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ‘মহাবিপর্যয়’ও বলা হয় দিনটিকে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে সেই দিন ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দখল করে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে ইসরাইল। এরপর থেকেই তাদের ওপর চলতে থাকে দখলদার বাহিনীর অমানবীয় নির্যাতন। 

ইসরাইলিরা অবরুদ্ধ অঞ্চলটির শুধু ভূমিই দখলে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ঘর-বাড়ি, প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ। ধ্বংস করেছে অবকাঠামো এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের পথ। অত্যাচার, অবহেলা ও হতাশায় ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে পরাধীনতার ৭৬ বছর পার করল গাজা। খবর আলজাজিরার।

ইসরাইলের আগ্রাসনের পর প্রথম দখল হয় ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসকারীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে অসলো চুক্তি অনুসারে। অধিকৃত পশ্চিম তীরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেখানে ইসরাইলিরা ৬০ শতাংশ ভূমিই নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। 

যৌথভাবে ইসরাইল-ফিলিস্তিনিদের দখলে আসে ২২ শতাংশ অঞ্চল। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ঝুলিতে থাকে মাত্র ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড। ইসরাইলিদের ৬০ শতাংশ দখল হওয়া ভূমিতে ৩ লাখ ফিলিস্তিনির বাসস্থান ছিল। কিন্তু ইসরাইলিরা সেই অংশটিতে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে অবৈধভাবে ২৯০টিরও বেশি ইহুদি বসতি স্থাপন করে। 

প্রায় সাত লাখ বসতি স্থাপনকারী বাস করে পশ্চিম তীরে। আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইলি এই বসতি অবৈধ। ফিলিস্তিনি হওয়ার কারণে বাড়ি তৈরির জন্য সেখানে ইসরাইলের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যায় না। তখন অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে অনেক ফিলিস্তিনি অনুমতি ছাড়াই বাড়ি তৈরি করতে বাধ্য হন। গত ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ৬২ বছর বয়সি ফাখরি আবু দিয়াবের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার সব স্মৃতি সেই বাড়িকে ঘিরে।’ 

২০০৯ সাল থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে অন্তত ১০ হাজার ৭০০টি ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়া ১৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। প্রতিদিন ভোরের আগে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিক তাদের কাজে বের হন। কিন্তু ইসরাইলি সামরিক চেকপয়েন্টগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়। 

এছাড়াও ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন এবং সম্পদের ওপর ব্যাপক বিধি-নিষেধ বসিয়েছে। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের বেকারত্বের হার বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে গেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের কারণে প্রায় ৫ লাখ ৭ হাজার ফিলিস্তিনি চাকরি হারিয়েছেন। 

ফিলিস্তিনের আর্থিক সম্পদের ওপর ইসরাইলের উলে­খযোগ্য প্রভাব রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ইসরাইল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ তত্ত্বাবধানকারী প্যালেস্টাইন অথরিটির (পিএ) হয়ে প্রতি মাসে প্রায় ১৮৮ মিলিয়ন ডলার কর সংগ্রহ করে, যা পিএ-এর মোট রাজস্বের ৬৪ শতাংশ। পিএ-এর ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে ইসরাইল। ফলে দখল হওয়া পশ্চিম তীর এবং গাজায় কর্মরত আনুমানিক এক লাখ ৫০ হাজার কর্মচারীর বেতন প্রদানে সমস্যার মুখে পড়ছে পিএ। 

১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন দখল করে এবং তিন লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করেছিল। তখন আরব বিশ্বের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আবার গাজায় ইসরাইল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সরঞ্জামের আমদানি সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। ইসরাইল যেখানে উচ্চগতির ৫জি মোবাইল ইন্টারনেট চালু করছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নেটওয়ার্ক অপারেটরদের শুধু অধিকৃত পশ্চিম তীরে (২০১৮ সাল থেকে) ৩জি এবং গাজায় ২জি ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনের প্রযুক্তি খাতকে থামিয়ে দিয়েছে। 

দখল হওয়া পশ্চিম তীরের প্রধান ভূগর্ভস্থ জলাশয়সহ এই অঞ্চলের বেশির ভাগ পানিসম্পদ ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন মাথাপিছু ১০০ লিটার নিরাপদ পানি ব্যবহারের কথা উলে­খ করেছে। ২০২৩ সালে ইসরাইলিরা গড়ে প্রতিদিন ২৪৭ লিটার পানি পেয়েছে, কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনিরা পান ৮২ লিটার পানি। 

অন্যদিকে ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলের বোমাবর্ষণে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, মসজিদসহ ২০০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থান ধ্বংস হয়েছে। এছাড়াও অবরুদ্ধ অঞ্চলটির বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৯০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে ইসরাইল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের দৈনন্দিন জীবন ইসরাইলি দখলদারির অধীনে খুব সীমিত হয়ে গেছে। এই নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। জাতিসংঘের পশ্চিম এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনের অর্থনীতিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। 

ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরাইলের নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যবস্থার অর্থ ‘নাকবা’ সত্যিই শেষ হয়নি।

LEAVE A REPLY