ফাইল ছবি
টটেনহামে কাটিয়েছেন ১৪ বছরেরও বেশি সময়। পেশাদার ফুটবলের হিসাবে সময়টা মোটেও কম নয়। হ্যারি কেইন যে ক্লাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, যেখানে একের পর এক গোল করে নিজের নাম তুলেছেন উঁচুতে, সেই ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবারের মৌসুম শুরুর আগে। এর পেছনে কারণ ছিল একটাই, অধরা শিরোপার স্বাদ পেতে চান এই স্ট্রাইকার।
১৪ বছরের ক্যারিয়ারে টটেনহামের জার্সিতে যা পারেননি সেই স্বাদ নিতে ৩০ বছরের এই স্ট্রাইকার পাড়ি জমান জার্মানিতে, বায়ার্ন মিউনিখে নাম লিখিয়ে। কিন্তু হায়! কেইন বায়ার্নে নাম লেখানোর পর একটি একটি করে শিরোপা যেন তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যায়। কী দুর্ভাগ্য তাঁর! যে বায়ার্ন গত এক যুগে একের পর এক শিরোপা জিতেছে, সেই দলে নাম লিখিয়েও কেইনের শিরোপাস্বপ্ন পূরণ হলো না। ৪৫ ম্যাচে ৪৪ গোল করা কেইনের সঙ্গে ১২ বছর পর বায়ার্ন মিউনিখও কাটাল ট্রফিবিহীন মৌসুম।
সমর্থকরা এর দায় চাপাচ্ছেন ‘গোলমেশিন’ কেইনের ওপর। বলছেন তিনি ‘অভিশপ্ত’!
টটেনহামের জার্সিতে ৪৩৫ ম্যাচে খেলে রেকর্ড ২৮০ গোল করেছেন হ্যারি কেইন। ২১৩ গোল নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। গোলের সুরভি ফুটিয়ে তিনবার জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।
জিতেছেন ২০১৮ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুটও। আর এবার প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জয়ও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে তাঁর। এর পরও কেইনের কেবিনেটে নেই কোনো ট্রফি। শিরোপার খুব কাছে গিয়েও যে প্রতিবারই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। টটেনহামের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলেছেন একবার।
সেখানেও সঙ্গী হয়েছে বিষাদ। লিভারপুলের কাছে কেইনের দল হেরে যায় ২-০ ব্যবধানে। সেদিন অবশ্য প্রতিপক্ষের বক্সে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেননি। ইংল্যান্ডের হয়ে ইউরোর ফাইনালেও খেলা হয়ে গেছে কেইনের। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য খোলেনি। ওয়েম্বলিতে ইতালির কাছে ইংলিশরা হেরে যায় টাইব্রেকারে। ইংলিশ লিগ কাপের ফাইনালে দুইবার খেলে দুইবারই সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়ে ফিরতে হয়েছে হ্যারি কেইনকে।
ইংল্যান্ডে হৃদয়ভাঙার গল্প জার্মানিতে বদলাতে চেয়েছিলেন কেইন। টটেনহাম ছাড়ার পর এই স্ট্রাইকার একটা কথাই বলেছিলেন, ‘ট্রফি জিততে চাই’। সেই ট্রফি তিনি ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচেই জিততে পারতেন। কিন্তু কথায় আছে না ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়!’ সেটাই হয়েছে কেইনের সঙ্গে। যে দলটি সর্বশেষ সাত আসরের ছয়টিতেই জার্মান সুপার কাপের শিরোপা জিতেছে সেই তারাই কিনা এবার হেরে গেল লিপজিগের কাছে ৩-০ গোলে। হ্যারি কেইন মাঠে নামলেন আর শিরোপা হারাল বায়ার্ন! সেই যে হƒদয়বিদারক গল্প সঙ্গী হলো, তা বয়ে বেড়াতে হলো মৌসুমের শেষ পর্যন্ত।
জার্মান সুপার কাপের পর জার্মান কাপ প্রতিযোগিতা ডিএফবি-পোকাল থেকেও বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় বায়ার্নের। মাত্র দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে তৃতীয় স্তরের দল সারবাকেনের কাছে হেরে যায় বাভারিয়ানরা। আর তাতে কেইনের শিরোপা ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা শুধু বাড়তেই থাকে। যদিও কেইন এগিয়ে যাচ্ছিলেন আপন মহিমায়। গোলের পর গোল করে বুন্দেসলিগায় রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ডে নাম লেখাতে থাকেন। মাত্র ১৬ ম্যাচেই করে ফেলেন ২২ গোল। এত কম সময়ে এত গোল আর কেউ করেনি। কিন্তু সেই কেইন পরের ১২ ম্যাচে করেন স্রেফ ছয়টি গোল। কেইনের সঙ্গে বায়ার্নও চলে যায় অফফর্মে। শীর্ষস্থান হারিয়ে বসে বেয়ার লেভারকুসেনের কাছে। সেই যে হারাল, এরপর আর ফিরে পেল না তা। মৌসুমের শেষ ভাগে এসে কেইন ছন্দে ফিরলেও বায়ার্ন আর পারেনি। ১১ মৌসুমের রাজত্ব হারিয়ে লিগ শিরোপা তুলে দেয় কখনো না জেতা লেভারকুসেনের হাতে। সেই সঙ্গে কেইনের আরেকটি স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে!
তখন সব আশা বেঁচে ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘিরে। অন্তত ইউরোপসেরা হয়ে মৌসুম শেষ করতে চেয়েছিল বায়ার্ন। না, সেখানেও হলো না। সমীকরণ মেলাতে পারল না টমাস টুখেলের দল। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ২-২ গোলে ড্র করার ম্যাচে পেনাল্টি থেকে একটি গোল করেছিলেন হ্যারি কেইন। ফিরতি লেগে রিয়ালের মাঠে শুরুতে এগিয়েও যায় বায়ার্ন। কিন্তু অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে শেষ মুহূর্তে দুটি গোল করে রিয়াল পৌঁছে যায় ফাইনালে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু থেকে বায়ার্ন ফেরে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে। দুই হাত মুখে চেপে মাটিতে হাঁটু গেড়ে দুঃখ লুকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় কেইনকে। বায়ার্নের এমন শূন্য হাতে মৌসুম শেষ করায় সমর্থকদের দায়ের আঙুল উঠেছে কেইনের দিকে। সামাজিক মাধ্যম এক্সে সমর্থকরা হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন, ‘কেইন কার্স’ বা ‘কেইন অভিশাপ।’ রিয়ালের কাছে হারের পর এক বায়ার্ন সমর্থক লিখেছেন, ‘২০১১-১২ মৌসুমের পর প্রথমবার বায়ার্ন মিউনিখ শূন্য হাতে মৌসুম শেষ করতে যাচ্ছে। এই মানুষটি (কেইন) অভিশপ্ত।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘সে অভিশপ্ত নয়, সে অভিশাপ!’ কেইনের জন্য মন খারাপ করা এক ভক্ত লিখেছেন, ‘তিনি অভিশপ্ত, এখন এটাই সত্য। এটা আর রসিকতা নয়, ট্রফি জিততে তাঁকে আর কী করতে হবে? তাঁর জন্য খারাপ লাগছে।’
শুধু বায়ার্নে নয়, টটেনহামেরও শিরোপা না জেতার পেছনে ‘অভিশপ্ত গোলমেশিন’ হ্যারি কেইন দায়ী তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন এসব সমর্থক। সাবেক ইংলিশ ফুটবলার রিও ফার্দিনান্দ অবশ্য কেইনের পাশেই থাকছেন, ‘কেইন নিজের কাজটা ঠিকই করেছে। বায়ার্ন কেইনকে এনেছিল শিরোপার ধারা বজায় রাখতে। কিন্তু আমি মনে করি, বাকিরা (দলের অন্য খেলোয়াড়রা) কেইনকে হতাশ করেছে।’ কেইন হতাশ করুক কিংবা তাঁর সতীর্থরা, সেই আলোচনায় না হয় পরে যাওয়া যাবে। কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করেও শিরোপার ছোঁয়া না পাওয়া হ্যারি কেইন সম্ভবত নিজেও মানছেন ভক্তদের ‘অভিশপ্ত’ তত্ত¡।