দুর্ঘটনা ঘিরে ধূম্রজাল

হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন পশ্চিমাদের কাছে ইরানের কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসাবে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাব্দুল্লাহিয়ানসহ নয় আরোহী। রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সোমবার সকালে নিহত নয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। এ খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে ইরানের জনগণ। দুর্ঘটনায় এ মর্মান্তিক মৃত্যুকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। অনেকে এর পেছনে ইসরাইলকে জড়িয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

১৯৮৮ সালে ইরানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও পরে দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন রাইসি। তার নেতৃত্বেই ইরানের সামরিক বাহিনী কিছুদিন আগে চিরশত্রু ইসরাইলের ভূখণ্ডে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় অনেকে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনাও শুরু হয়েছে। 

ইরান এখন পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারি বৃষ্টিপাত আর ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটের দৃষ্টিসীমায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে এই দুর্ঘটনায় শত্রুপক্ষের জড়িত থাকার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট রাইসির মেয়াদ ও ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে দেশি শত্রু, এমনকি ইসরাইলের মতো বহিরাগত শক্তির সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয় নিয়েও অনেকে আলোচনা করছেন। 

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এবং ইসরাইলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরাইল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরাইলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরে ইসরাইলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা বিবেচনায় এই তত্ত্ব নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন।

ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা এবং নিখুঁত অভিযান চালানোর জন্য ইসরাইলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। যদিও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা কখনোই কোনো রাষ্ট্রের প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় সন্দেহবাদীদের ইসরাইলি সংশ্লিষ্টতার তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছেন। 

তারা বলেছেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হত্যার ঘটনা সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাবে। এমনকি ইরানের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া আসবে। যদিও ঐতিহ্য বিবেচনায় ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থান উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে সামরিক এবং পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতেই রয়েছে। 

ইকোনমিস্ট বলছে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসরাইলের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করার জোরালো কারণ রয়েছে। ইসরাইল কখনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার মতো এতদূর অগ্রসর হয়নি। এর অর্থ হবে দ্ব্যর্থহীন যুদ্ধ; যা ইরানের তীব্র প্রতিক্রিয়া উসকে দেবে।

মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথম কথা হলো এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ব্যর্থতার কারণেই এটা ঘটেছে। ব্যর্থতা কি সিকিউরিটি রিলেটেড, নাকি টেকনিক্যাল না অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এটি অন্যান্য তথ্যাবলি পাওয়ার পরে আমরা হয়তো বলতে পারব। এটি শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই প্রভাব বিস্তার করবে তা নয়। রিজিওনালি এবং আন্তর্জাতিকভাবেও এর প্রভাব আমরা টের পাব শর্টটার্মে অথবা মিডটার্মে। তিনি বলেন, এই অ্যাক্সিডেন্টটা কখন হলো এটাও একটা বিষয়। 
যেমন ইসরাইলের সঙ্গে যে সমস্যাটা চলছে ইরানের, সেটাও গুরুত্ব বহন করছে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইরান বিভিন্ন ধরনের ইকোনমিক ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে তাতেও এর প্রভাব পড়ছে। আমরা যদি একসঙ্গে অন্যান্য তথ্যাবলি মেলাতে না পারি, তবে সঠিকভাবে বুঝতে পারব না ঘটনাটা কেন ঘটল। তবে এর যে একটা প্রভাব পড়বে এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত আর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই হেলিকপ্টারটি অনেক পুরোনো ছিল। ১৯৭২ সালের তৈরি এই হেলিকপ্টার। প্রচণ্ড কুয়াশা ছিল। তুষারপাতের কথাও ছিল। এটি দুর্ঘটনাও হতে পারে। তিনি বলেন, উনি যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে গিয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়ায় ইরানের সমর্থনে ইসরাইল বিরোধীরা যেভাবে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছিল সেই জায়গায় শ্লথগতি আসতে পারে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, এখনকার মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতায় এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, এমন চিন্তাও আসতে পারে না তা নয়। তবে আমার ধারণা এটি দুর্ঘটনা। হেলিকপ্টারটি ৫০ বছর আগে তৈরি। সেটি যদি যথাযথ পর্যবেক্ষণ না করা হয়, তাহলে যান্ত্রিক গোলযোগের আশঙ্কা থাকতেই পারে। আর এমন একটা জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, এটি ঘন কুয়াশা, পার্বত্য অঞ্চল। তিনি বলেন, এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিষয়ে একটু তফাত আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো জটিলতা তৈরি হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জটিলতা তৈরি হতে পারে। 

প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার : প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল বেল-২১২ মডেলের। এই মডেলটি ইউএইচ-১এন ‘টুইন হুয়েই’র বেসামরিক সংস্করণ। এ হেলিকপ্টার বিশ্বব্যাপী সরকারি-বেসরকারিভাবে বহুল ব্যবহৃত। ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে মূল ইউএইচ-১ ইরোকুইসের আপগ্রেড হিসাবে কানাডিয়ান সামরিক বাহিনীর জন্য এটি তৈরি করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান বেল হেলিকপ্টার। এর আপগ্রেড মডেলের ডিজাইনে একটির বদলে দুটি টার্বোশ্যাফ্ট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে এর বহন ক্ষমতা বেড়েছে। মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণ নথি অনুসারে, নতুন মডেলের এই হেলিকপ্টার ১৯৭১ সালে তৈরি করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এর ব্যবহার শুরু হয়। পরিবহণ হেলিকপ্টার হিসাবে এই মডেল মানুষ বহন, এরিয়াল ফায়ার ফাইটিং গিয়ার মোতায়েন, কার্গো বহন ও অস্ত্র মাউন্ট করাসহ সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য উপযোগী। এটি ক্রুসহ ১৫ জনকে বহন করতে পারে।

ইসরাইলের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত নেই : প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে বিশ্বনেতারা শোক বা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। তবে ইসরাইল পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছে বা সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাবে। তারা খেয়াল রাখছেন, ইরানের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি চক্রান্তের ইঙ্গিত দেওয়া হয় কিনা। অবশ্য ইরানের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত অবশ্য তেমন কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।

ইসরাইলের কর্মকর্তারা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানাচ্ছেন, ইরানে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পেছনে তাদের কোনো হাত নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকেও একই কথা জানিয়েছেন ইসরাইলের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা শুধু অল্প কথায় বলেছেন, ‘এর সঙ্গে আমরা জড়িত নই।’

LEAVE A REPLY