আরো তিন সেবায় রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক

দেশে বর্তমানে ৪৪টি সেবার বিপরীতে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরো তিনটি সেবার ওপর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে সরকার। এতে মোট ৪৭টি সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তবে কোন কোন সেবায় রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হবে, সুস্পষ্টভাবে তা জানা যায়নি। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৩৮টি সেবার ওপর আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা ছিল। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরো ছয়টি সেবার ওপর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। পর পর দুই অর্থবছরে সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করায় রিটার্ন দাখিল উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশে ভ্যাটের অবস্থান শীর্ষে। এর পরের অবস্থানে আয়কর। অথচ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে আয়কর খাতের অবস্থান থাকে সবার ওপরে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকেও প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর চাপ আছে।

সুতরাং আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে এমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নেবে না, যাতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি হয়।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিতে গেলে যখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হবে, তখন চাইলেও কেউ কর এড়িয়ে যেতে পারবে না। কর দেওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

জানা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আহরণে তলানিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আইএমএফ তাই ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্য দিয়েছে। বর্তমানে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৭.৮ শতাংশ। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটির শর্ত মোতাবেক ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এনবিআরকে সে অনুপাত ৯.৫ শতাংশ করতে হবে। সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। আয়কর থেকে আগামী তিন অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে চার লাখ ৯৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এরই মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আরো কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপের বিষয়েও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। গত কয়েক বছরে রাজস্ব আহরণে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তাই আইএমএফ প্রগ্রামের আওতায় বাড়তি রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এনবিআর কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেই তা পূরণ করা সম্ভব। আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করা হয়েছে বলেও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে রয়েছে ই-পেমেন্ট, ই-রিটার্ন ফিলিং, ই-টিডিএস, ই-অফিস ম্যানেজমেন্ট ও ই-টিআইএন সিস্টেম।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১ মে পর্যন্ত দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি দুই লাখ ২২ হাজার ৭৬। অন্যদিকে রিটার্ন জমা দেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার ৬১৫। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন ৩০ লাখ ২৮ হাজার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিটার্ন জমা পড়েছিল ২৫ লাখ ৫৪ হাজার ২১৫।

সে হিসাবে গত দুই বছরে প্রায় ১৫ লাখ রিটার্নদাতা বেড়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, রিটার্ন জমা দেওয়ার আওতা বাড়লে আয়করের ভূমিকা বাড়বে। বর্তমানে ৪৪ ধরনের সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করায় আয়করদাতার সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এনবিআরের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের সঙ্গে যৌথভাবে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর বিষয়টিও কর আহরণ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ৪৪ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবার বিপরীতে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) সনদের পরিবর্তে আয়কর রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

৪৭ সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক

এখন থেকে যে ৪৭টি সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হবে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকঋণ নিতে চাইলে, কম্পানি পরিচালক পদ পেতে, আমদানি-রপ্তানি সনদ, ব্যবসা শুরুর ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়নকালে, সমবায় সমিতির লাইসেন্স নিতে, বীমা কম্পানির সার্ভেয়ার হিসেবে নিবন্ধন পেতে, ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রিকালে, ক্রেডিট কার্ড নিতে, পেশাজীবী সংগঠনের (চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, সার্ভেয়ার) সদস্য পদ পেতে, কাজী সনদ গ্রহণ করতে, বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য পদ পেতে, ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র ও বিএসটিআইয়ের সনদ পেতে, বাণিজ্যিক ও শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগ অথবা সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ পেতে, নৌযানের সার্ভে সনদ নিতে, ইটভাটা চালু করতে, বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে, কম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেতে, আগ্নেয়াস্ত্র সনদ পেতে, আমদানির এলসি খুলতে, পাঁচ লাখ টাকার বেশি ডাকঘর সঞ্চয়পত্র ও পাঁচ লাখ টাকার বেশি অন্য সঞ্চয়পত্র কিনতে, ব্যাংক হিসাব খুলতে, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ও বাড়ির নকশা অনুমোদনে।

এ ব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, সেবা নিতে গেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করলে কমপ্লায়েন্স বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিক চর্চার মধ্যেই পড়ে। এটি অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করলে প্রান্তিক পর্যায়ে কর আদায় খুব একটা না বাড়লেও একটি ভালো ট্যাক্স কালচার তৈরি হবে।

LEAVE A REPLY