বাবার এক টুকরো মাংস এনে দাও ছুঁয়ে দেখব

‘আমার বাবার এক টুকরো মাংস এনে দাও। আমি ছুঁয়ে দেখব। টুকরোকেই বাবা মনে করে জানাজা করতে চাই।’ শুক্রবার বিকালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এক মানববন্ধনে অংশ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে একথা বলেন কলকাতায় নৃশংসভাবে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মানববন্ধনে তিনি আবারও বাবার হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে বলেছেন-এই মুহূর্তে বাবার মরদেহ দেশে আনাই প্রধান কাজ। তিনি বলেন, হত্যাকারীদের বিচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আশ্বস্ত করেছেন।

এমপি আনার হত্যার প্রতিবাদ ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কালীগঞ্জ শহরের মেইন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মানববন্ধনটি বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে শেষ হয় সাড়ে ৫টার দিকে। আনারের নিজ গ্রাম নিশ্চিন্তপুর গ্রামবাসী এ মানববন্ধনের আয়োজন করেন। নারী-পুরুষ-শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন।

মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন পৌর মেয়র আশরাফুল আলম। উপস্থিত ছিলেন নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান, ইউপি চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হোসেনসহ দলীয় নেতাকর্মী ও শত শত সাধারণ মানুষ। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এমপি আনার কন্যা ডরিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আজ যে জায়গায় আমি কথা বলছি একই স্থানে আমার বাবা অনেক প্রোগ্রাম করেছেন। আজ সবাই আছে শুধু দেখছি আমার বাবা নেই। আপনারা যারা আজ এখানে এসেছেন তারা কেউ ভেঙে পড়বেন না। আমরা এখানে বিচার চাইতে এসেছি। দেহে একবিন্দু রক্ত থাকা অবস্থায় বাবার হত্যার বিচার চাইব। ডরিন বলেন, কী অপরাধ করেছে আমার বাবা। পরিবারেও সময় ঠিকমতো দেয়নি। আজ তার এই করুণ পরিণতি হলো যে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মরদেহ টুকরো টুকরো করে মসলাও মাখানো হয়েছে!

সাংবাদিকদের উদ্দেশে ডরিন বলেন, আজ অনেক সাংবাদিক ভাইয়েরা নিউজ করছেন। সে (বাবা) এই ব্যবসা করে, ওই ব্যবসা করে। আপনারা কি জানেন একটা সময়ে তিনি কেন ভারতে থাকতেন? ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল চারদলীয় জোটের সময় এভাবেই তাকে মারার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তখন তার হায়াত ছিল বলে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতে ১৪ বছর থেকেছেন। অনেকে আশ্রয় দিয়েছেন। তার নামে যে মামলাগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলোতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

ডরিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাবা হারানোর ব্যথা-কষ্ট বোঝেন। তিনি আমার বাবা হারানোর বেদনা বুঝবেন। তার বাবার হত্যার বিচার করেছেন, আমার বাবার হত্যার বিচারও করবেন। হত্যার পরিকল্পনাকারীকে ধরার পরই খতিয়ে দেখা যাবে আসলে কি জন্য সে এত বড় অপকর্ম ঘটাল। এর বিচার অবশ্যই হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে আমাকে ফোন দিয়েছেন। তিনি আমাকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তুমি আমাকে বলেছ তোমার বাবাকে খুঁজে দিতে, আমি ইন্ডিয়ান পুলিশকে দিয়ে তোমার বাবাকে খুঁজে দিয়েছি। আর কি চাও আমাকে বলো। এখন পুলিশ তদন্ত করবে রিপোর্ট আসলে আমি ব্যবস্থা নেব। আর কিছু করতে হলে আমাকে জানাও। আমি তখন বলেছি, আপা আপনি যা ভালো মনে করেন করবেন, আপনি বিচক্ষণ, আপনিই এর বিচার করবেন।

তিনি আরও বলেন, কালীগঞ্জের মানুষের সুখে দুঃখে যিনি সব সময় পাশে থেকেছেন সেই মানুষটির হত্যার বিচার আমরা চাই। আমি ভারতের ভিসা পেয়েছি। তবে ডিবি অফিস থেকে আমাকে বলেছে, যখন প্রয়োজন হবে তখন ভারতে যেতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেই আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। দুই মাস ধরে পরিকল্পনা করে সাজিয়ে গুছিয়ে তারা এই কাজটি করেছে। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তদন্তের মাধ্যমে যেটাই বেরিয়ে আসুক, সেটা রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক যেটাই হোক তাদের শাস্তি চাই। আমার বাবা কালীগঞ্জ শহরে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছে, তার শত্রু থাকতেই পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে হত্যা কি না সে বিষয়টি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। ২০০৪ সালে বাবা যখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করত, তখন বিএনপির একটি গ্রুপ তার পেছনে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছিল। পরবর্তীতে তার নামে সব মামলা মিথ্যা বলে প্রমাণ করেছেন আদালত। বাবা একজন নেতা হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। এজন্য তার শত্রু ছিল। এখন অনেক পুরাতন কথা উঠে আসছে। এসব পুরাতন কথা টেনে সামনে আনার কোনো দরকার নেই। সে যদি বলতেই হয় তাহলে এটাও সামনে আনেন, আমার বাবা দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে বাড়িতে আসতে পারেনি, আমাদের মুখ দেখতে পারেনি সেই কষ্টের কথাও তুলে ধরেন আপনারা।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র বলেন, কালীগঞ্জ থেকে যে ফুল ঝরে গেছে সেই ফুল আর ফুটবে না। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্মসূচি পালন করেই যাব। এমপি আনারের বাল্যবন্ধু গোলাম রসুল বলেন, এমপি আনার মানুষের দুয়ারে দুয়ারে নিজে গিয়ে সেবা দিয়েছেন। সেই আনারকে এভাবে হত্যা করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, এই পরিবারের মাথার উপর থেকে আপনার হাতটা ফিরিয়ে নেবেন না।

কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বলেন, শেষবারের মতো প্রিয় নেতাকে দেখতে চাই। তার লাশের এক টুকরো মাংস হলেও সেটাকে নেতা মনে করে জানাজা করতে চাই।

LEAVE A REPLY