শ্রমিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকায় মালয়েশিয়া হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই অনিয়ম হয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থানপ্রত্যাশী শ্রমিকদের ওয়ার্ক ভিসার বদলে দেওয়া হয়েছে ভ্রমণ ভিসা। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।
ভিসাপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার নিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ শ্রমিকের ভিসা অনুমোদন করা হয়েছে। এভাবে দিনে গড়ে দেড় লাখ ডলার আত্মসাৎ করেছে তারা। এ টাকা দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ান হাইকমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিদেশে পাচার করেছেন।
ভিসা বাণিজ্যের এই চক্রে আছেন অসাধু বাংলাদেশিরাও। যারা হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা বিদেশে পাচারে সাহয়তা দিয়েছেন। এছাড়া হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের এই কাজে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক শিবেন বিশ্বাস যুগান্তরকে জানান, এই চক্রে জড়িত দশ বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন, আবুল হাসেম, কবীর হোসেন, ইমতিয়াজ আহমেদ, সত্যজিৎ সরকার, মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবগত করা হয়েছে।
গত জানুয়ারি মাসে এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত শেষ করে কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা শাখা। এর আগে গত বছর এই চক্রের অন্যতম সদস্য মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চক্রের অন্য সদস্যদের নাম। এরপর ঢাকায় মালয়েশিয়া হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হয় গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।
পরে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) তাদের দুজনকে গ্রেফতারের কথা জানায়। তাদের মধ্যে মালয়েশিয়ান নাগরিক ইজজাতুল দিয়ানা জয়নুদ্দিন রয়েছেন।
এছাড়া চক্রে বাংলাদেশি সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন ফয়েজ মিয়া, মো. আবুল হাসেম, বাবুল মীর, মোহাম্মদ কবীর হোসেন, মো. ইমতিয়াজ আহমেদ, সত্যজিৎ সরকার, মো. সেলিম হোসেন, শাহান আরা হক ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
এ ঘটনায় গ্রেফতার দুই মালয়েশিয়ান কর্মকর্তার ২০টির বেশি ব্যাংক হিসাব ও আনুমানিক ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন মালয়েশীয় রিঙ্গিত ও ৮টি প্লট জব্দ করেছে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি)। তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন অ্যাক্ট ও অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং, অ্যান্টি-টেরোরিজম ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড প্রসিডস অব আলফুল অ্যাক্টিভিটিস অ্যাক্টের অধীনে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত বছরের ৬ এপ্রিল জাহাঙ্গীরসহ ৪ জনকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি মুদ্রা, জাল নোট ও অসংখ্য পাসপোর্ট উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে রয়েছে ৭টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, নগদ ২ কোটি ৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ২০ হাজার টাকার জাল নোট, ৫১ হাজার ইউএস ডলারসহ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত।
জানা গেছে, সংঘবদ্ধ এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য এজেন্সি। যারা বিদেশে কর্মসংস্থানপ্রত্যাশীদের খুব সহজে ওয়ার্ক ভিসা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলত। এজন্য বেশি বেতনে ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগসহ নানা লোভনীয় কথা প্রচার করত। পরে আগ্রহীদের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্কে চুক্তি করে।
এরপর তাদের পাসপোর্ট রেখে দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভ্রমণ ভিসা অনুমোদন করিয়ে নিত। এভাবে বহু বছর ধরে চক্রটির হাতে প্রতারিত হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। তাদের মাধ্যমে পাচার হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এসব টাকা দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তারা ভোগবিলাসে ব্যয় করেছেন, গড়েছেন অঢেল সম্পদ।
হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অবৈধভাবে টাকা আয় করেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তাকে লাকসামের ফয়েজ ও হরাইজন এক্সপ্রেসের বাবুল মীর পাসপোর্ট সরবরাহ করেছে।
গ্রেফতারের পর জাহাঙ্গীর মালয়েশিয়ান হাইকমিশনের ‘মেসেঞ্জার’ হিসাবে কাজ করেন বলে দাবি করেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০২১ ও ২০২২ সালে কয়েকজন মালয়েশিয়ান অফিসার ভিসা বিভাগে যোগ দেন। তাদের মধ্যে ইজাতুল দিয়ানা জয়নুদ্দিন নামে এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য হয়। তার মাধ্যমে প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০টি ট্যুরিস্ট ভিসা প্রসেসিং করতেন।
প্রতি ভিসা বাবদ ইজাতুল দিয়ানাকে ৪০০ থেকে ৫০০ ইউএস ডলার দিতেন এবং নিজে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পেতেন। কিছুদিন পরপর অনেক টাকা জমা হলে মনি এক্সচেঞ্জের আবুল হাসেমের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করতেন। এসব টাকা ইজাতুল দিয়ানা তার স্বামী ও মেয়ের নামে থাকা ’মে ব্যাংক’ অ্যাকাউন্টে জমা করতেন।
এছাড়া নিজের ‘এমএন্ডএস কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ট্রেডিং’-এর নামের ব্যাংক হিসাবে (মে ব্যাংক ও আরএইচবি ব্যাংক) জমা করেছেন। এছাড়া হাসেমের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মিস আমিরা নামে একজনের কাছেও টাকা পাঠাতেন।
গ্রেফতার সত্যজিৎ সরকার জানায়, ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ান হাইকমিশনে ’ট্রেড অ্যান্ড ইনফরমেশন সহকারী’ হিসাবে যোগ দেন। ২০১২ থেকে ১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইমিগ্রেশন বিভাগে কাজ করেন। এই সময়ে মালয়েশিয়ান কর্মকর্তারা তাকে মাসে ৩ লাখ টাকা চুক্তিতে চক্রে যুক্ত করে। তাদের মধ্যে ছিলেন মি. ডেলড্রি, ম্যাডাম রশিদা ও মি. রসলি। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা উপার্জন করে। তখন সে ইফাজ ট্যুরস, মমি, জেএএফ এই তিনটি এজেন্সির মাধ্যমে কাজ পেত।
তার সঙ্গে জাহাঙ্গীর, ইজাতুল দিয়ানা, মি. আজিজান ও মি. ইরহামের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়। বাংলাদেশি কবির, সুমন, ইমতিয়াজের সঙ্গেও সখ্য হয়। এরা সবাই সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৩৫০ শ্রমিককে ওয়ার্ক ভিসার পরিবর্তে ট্যুরিস্ট ভিসার অনুমোদন দিত। প্রতিটি ভিসায় ৫০০-৬০০ ডলার নিত। এভাবে প্রতিদিন ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার নিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে।
জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে ঢাকার হাইকমিশনের অনিয়মের চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযুক্ত ইমতিয়াজ জানায়, সে ২০১৪ সালে দূতাবাসটির ‘হোম মিনিস্ট্রি ইমিগ্রেশন বিভাগের সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা’র দায়িত্ব পান। তখন ’ইমিগ্রেশন এটাচি’কে দিয়ে ভিসাপ্রতি ২০ হাজার টাকায় ৫০টি ভিসার অনুমোদন করেন। এই টাকার ৭৫ শতাংশ ’ইমিগ্রেশন এটাচি’কে দিতে হতো। এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় সে দশ লাখ টাকা আয় করেছে।
গোয়েন্দা পুলিশকে ইমতিয়াজ আরও জানায়, ইজাতুল দিয়ানার মাধ্যমেও তিনি এই কাজ করেছেন। জাহাঙ্গীর প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ভিসা করাত ইজাতুল দিয়ানাকে দিয়ে। এজন্য তাকে ১৫ হাজার ডলার দিয়েছেন আর জাহাঙ্গীর প্রতিটির জন্য ১০০ ডলার পেয়েছেন। এভাবে প্রায় ৩ হাজার ওয়ার্ক ভিসাকে ট্যুরিস্ট ভিসা হিসাবে অনুমোদন দিয়েছেন ইজাতুল।
শ্রমিকদের সঙ্গে এই প্রতারণায় যুক্ত ছিল ডেল্টা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, পিরামিড, মমি ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস, আজগর ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতার বাবুল মীর হরাইজন এক্সপ্রেস লিমিটেড নামের ট্রাভেল এজেন্সিতে পিয়নের কাজ করেন। অফিসের কাজের পাশাপাশি জাহাঙ্গীর হোসেনকে দিয়ে ৯৯২টি ভিসা প্রসেসিং করে। প্রতিটি পাসপোর্টে ৭৫ থেকে ৭৬ হাজার টাকা নিত বাবুল মীর। সেখান থেকে জাহাঙ্গীরকে ৬৯ হাজার টাকা দিয়েছে। বিভিন্ন সময় টাকা মানি এক্সচেঞ্জের হাসেমকেও দিয়েছেন।
এভাবে প্রায় ৭ কোটি টাকা বাবুল মীর জাহাঙ্গীর এবং হাশেমকে দিয়েছেন। এই চক্রে জড়িয়ে অবৈধভাবে সে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় করেছে বলে স্বীকার করেছেন।
আবুল হাসেম জানিয়েছেন, সে ২০০৫ সাল থেকে মানি এক্সচেঞ্জে কমিশনভিত্তিক কাজ করে। তার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের পরিচয়ের একপর্যায়ে গত বছর ৪৫০টি পাসপোর্ট নম্বরে মেসেজ করে পাঠায়।
এই পাসপোর্টগুলোর ভিসা প্রসেসিং বাবদ টাকা বাবুল মীরের কাছ থেকে নিতে বলেন। তাদের বার্তা আদান-প্রদানের আলাদা সিম ছিল। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে টাকাগুলো হুন্ডির মাধ্যমে ইজাতুল দিয়ানার স্বামী ও মেয়ের অ্যাকাউন্টে পাঠাত। এজন্য সে ১৫ পয়সা পর্যন্ত কমিশন পেত। জাহাঙ্গীর ও বাবুল মীর তাকে পাচারের জন্য মোট ২৪ কোটি টাকা দেয়।