২০১৯ সালে বাঘ জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই জরিপে বাংলাদেশের বাঘের সংখ্যা উঠে আসে ১১৪টি। বাঘের সংখ্যা জানতে জরিপ শেষ হলেও তথ্য পর্যালোচনার চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেই জরিপের প্রাথমিক তথ্যে বাংলাদেশে এবারে বাঘের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী মাসের শেষের দিকে চূড়ান্ত তথ্য প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে, ২৯ জুলাই পালিত হবে বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘ টিকে আছে বিশ্বে এমন ১৩টি দেশে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিনটি বিশ্ব বাঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও চারটি দেশে ইতোমধ্যে বাঘ বিলুপ্তি হয়েছে এবং একটি দেশে বিলুপ্তির পথে।
প্রতি বছর দিবসটিকে ঘিরে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। তবে দেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও বাঘ গণনা জরিপ কাজ শেষ না হবার কারণে এবারের অনুষ্ঠান পিছিয়ে আগষ্টের শেষ সপ্তাহে করা হতে পারে। এবারের বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে এমন বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। এজন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে বাঘ দিবস পালনের দিন এ প্রতিপাদ্য প্রকাশ করা হবে।আরও পড়ুন

আইন-বিধি থাকলেও মৃত্যু কমেনি সড়কে
বিভিন্ন সময়ে বাঘের পরিমাণ
জানা যায়, ২০০৪ সালে দেশে বাঘের সংখ্যা ছিলে ৪৪০টি, যার মধ্যে ১২১টি পুরুষ, ২৯৮টি স্ত্রী এবং ২১টি বাচ্চা ছিলে। ২০০৯ সালে ৩০০-৫০০ টির বাঘের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলে বলে বন অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেশে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় হয় ২৫০টি। আর ২০১২ সালে ডবি্লউটিপির জরিপে জানা গেছে, দেশে এক দশকে বাঘের সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানানো হয়। এরপর ২০১৫ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে দাড়ায় মাত্র ১০৬টি।অন্যদিকে ২০১৭ সালে ১২১টি পাওয়া গেলেও ২০১৯ সালে তা ছিলে ১১৪টি। তবে গণনাগত পদ্ধতির কারণে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে বড় তারতম্য দেখা দিয়েছে। ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে বাঘের গণনা ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে পরিচালানা করা হয়। অন্যদিকে ২০১৭ সালে মূলত ডিএনএ পদ্ধিতিতে গণনা করা হয়। কার্যকরভাবে বাঘ আছে এমন ৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাতে। তবে চলতি বছরের জরিপ তথ্য প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে আসতে পারে।
বাঘ বৃদ্ধির কারণ
বাঘের গণনায় ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনার অন্যতম পদ্ধতি হলো বাঘের পায়ের ছাপ গণনা ও সেই তথ্য বিশ্লেষণ করা। জরিপের সঙ্গে জড়িত গবেষকরা জানিয়েছেন, গত জরিপের পাওয়া বাঘের পায়ের ছাপের তুলনায় এবারে সেটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত নৌ চলাচলের কারণে বাঘের আবাস স্থল দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে একপাশের বাঘ অন্য পাশে যেতে পারে না। এতে হুমকিতে পড়ে বাঘের জীবন চক্র। এ ছাড়া কভিড-১৯ এর কারণে সুন্দরবনে পর্যটকদের চলাচল সীমিত ছিল প্রায় দুই বছর। এমনকি সুন্দরবনে মাছ ও পাতা আহরণেও সীমাবদ্ধতা ছিল। গত দুই বছর নিয়িন্ত্রতভাবে পর্যটক প্রবেশ করেছে। এতে বনের মধ্যে বাঘ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলাচল করতে পেরেছে। বনের মধ্যে বাঘের খাবার বেশি তৈরি হয়েছে। তেমনি বাঘের প্রজনন নির্বিঘ্ন হয়েছে। বাঘের অন্যতম খাবার হলো হরিণ। এই হরিণ প্রায় ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বন্য শুকর ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতিক সময়ে সন্দরবন ঘুরতে যাওয়া পর্যটনকরাও বাঘের চলাচল কিংবা নদী পাও হওয়ার চিত্র বেশি দেখতে পেয়েছেন।আরও পড়ুন

ফরিদপুরে বাসচাপায় প্রাণ গেল কলেজছাত্রের
এ বিষয়ে বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমরা বাঘ দিবসের অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিয়েছি। আমাদের বাঘ জরিপের প্রাথমিক তথ্যে বাঘের পরিমাণ বাড়তে পারে বলে প্রাথমিক তথ্য এসেছে। জরিপকালীন বাঘের পায়ের চিহ্ন অনেক বেশি দেখা গেছে। আমাদের জরিপ তথ্য বলছে এই সময়ে বাঘের খাবার দ্বিগুনের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাঘের ব্রিডিং বেশি হয়েছে।
বাঘ সুরক্ষায় বন অধিদপ্তর সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন অধিদফতর ও স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের টিম গঠন করে স্মার্ট পেট্রোলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কমিউনিটি অংশগ্রহণ বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য সুন্দরবনের আয়তনের ২৩-৫২ ভাগ এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাঘ রক্ষায় বন বিভাগের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও র্যাবের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ বাঘের অস্তিত্ব আরো বাড়াতে সব পদক্ষেপই গ্রহণ করা হচ্ছে।
বাঘের মৃত্যু
গত ৩০ এপ্রিল বিকেলে খুলনার দাকোপ উপজেলাধীন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আন্ধারিয়া খাল থেকে ভাসমান অবস্থায় বাঘের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। পুরুষ প্রজাতির বাঘটির আনুমানিক বয়স ছিল ১১ বছর। এরপর গত ১ মে বাঘটির ময়নাতদন্ত রিপোট প্রকাশ করা হয়। বাঘটির দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বাঘটি রোগাক্রন্তও ছিল না বলে প্রমাণ মিলেছে। দাবদাহে বাঘটি হিট স্ট্রোকে বাঘটি মারা গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে বন বিভাগ।
এর আগে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব সুন্দরবনের আওতাধীন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কচিখালীর একটি খাল থেকে এক বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। এভাবেই ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ বছরে সুন্দরবনে নানাভাবে ৪২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২৬টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি। ফলে সন্দরবনের পূর্ব এলাকা বাঘের মৃত্যুর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আরও পড়ুন

আইন-বিধি থাকলেও মৃত্যু কমেনি সড়কে
বাঘের অঙ্গের চোরাচালান
বন্য প্রাণীর বাণিজ্য নজরদারি সংগঠন ‘ট্রাফিক’ এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৩টি চোরা শিকারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৩টি বাঘের অপমৃত্যু হয়েছে। তা ছাড়া বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাঁত, নখ পাচার হচ্ছে। গত ২২ বছরে ৩৬টি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জব্দ ও ৫০টি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বাঘের জব্দ ও অবৈধ বাণিজ্যে ২৩টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, চার্জশিট আনা হয়েছে ৪৩ জন এবং জরিমানা করা হয়েছে ৪ জন এবং জেল দেওয়া হয়েছে ৬ জনকে। সারা বিশ্বে বাঘের যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে রয়েছে। বন্যপ্রাণী আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাই এ আইনটিও অপরাধীদের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা স্পস্ট। আরও পড়ুন

আইন-বিধি থাকলেও মৃত্যু কমেনি সড়কে
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বাঘ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা আরো বেশি বাড়াতে হবে। এছাড়া চোরা শিকারিকে শুন্যে নামিয়ে আনতে বন অধিদপ্তরকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে আরো বেশি বাস্তবায়ন উপযোগী করতে হবে। প্রয়োজনে বন অধিদপ্তরে স্পেশাল ফোর্স নিয়োজিত করতে হবে। পাশাপাশি অবাধে এ অঞ্চলে শিল্প স্থাপন নিরুৎসাহিত করা এবং নদীর ভেতর দিয়ে নৌ চালাচলকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। বাঘ যাতে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে বের হতে না পারে, এ জন্য বনের সীমানা এলাকায় বন বিভাগের টহল বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড কনসারভেশন সোসাইটির (ডবি্লউসিএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাচারের ক্ষেত্রে অস্ত্র ও ড্রাগের পরই রয়েছে বন্যপ্রাণী। বন্যপ্রাণী নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কালো বাজার চলছে। এ বাজারে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার আদান-প্রদান হচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর বড় অংশ আজ বিলুপ্ত প্রায়। বন্যপ্রাণী শিকার, পাচার এবং পণ্য হিসেব ব্যবহারের জন্য এশিয়া একটি বৈশ্বিক হটস্পট। বাংলাদেশের বাঘের রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।আরও পড়ুন

কিশোর ফাইয়াজ টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে
বৈশ্বিক বাঘ পরিস্থিতি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে, (অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ) বিশ্বে এক সময় ৯ প্রজাতির বাঘ বিরজমান ছিলো। তবে ইতোমধ্যে ৩ টি প্রজাতির বাঘ বিলুপ্তি হয়েছে। জাভান, কাসপিয়ান প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হলেও সাউথ চাইনা টাইগার বিলুপ্তির পথে রয়েছে। ১৯৪০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৬০ হাজার বাঘ ছিল। তবে ২০১৮ সালে তা নেমে আসে ৪ হাজার ৭৪৮টিতে। এর মধ্যে ভারতেই রয়েছে ২ হাজার ৯৬৭টি। এ ছাড়া রাশিয়াতে ৫১০টি, ইন্দোনেশিয়াতে ৩৭১টি, মালয়শিয়াতে ২৫০টি, নেপালে ২৩৫টি, থাইল্যান্ডে ১৮৯টি, বাংলাদেশে ১১৪টি, ভুটানে ১০৩টি এবং চীনে ৭টি। বিশ্বের পাচটি দেশে বাঘ প্রায় কিংবা পুরোপুরি বিলুপ্তি হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার বাঘ শূন্য হয়েছে, লাওসে ২টি বাঘ রয়েছে এমন তথ্য ৫ বছর আগে দিলেও এখন তারা আপডেট নেই, অন্যদিকে কম্বোডিয়াতে ২০১৭ সালে এবং ভিয়েতনাম ১৯৯৭ সালে বাঘ বিলুপ্তি এমন ঘোষণা দিয়েছে। তবে চীনেও বিলুপ্তির পথে রয়েছে।