ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকার পতনের মাত্র ৯ দিনের মাথায় বিচারের মুখোমুখি দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রাজধানীর নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় বুধবার বিকালে তাদের আদালতে তোলা হয়। জনাকীর্ণ আদালতে স্বল্পসময় শুনানির পর আসামিদের ১০ দিন করে রিমান্ড (পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ) মঞ্জুর করেন আদালত।
আদালতে হাজির করা হলে উপস্থিত বিক্ষুব্ধ আইনজীবীদের অনেকেই আসামিদের ওপর চড়াও হন। দু-একজন তাদের গায়ে হাতও তোলেন। পরে পুলিশ দ্রুত আসামিদের সরিয়ে নেয়। এদিকে শুনানির সময় আদালতে জানানো হয় গ্রেফতারের সময় সালমান এফ রহমানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এবং নিষিদ্ধ স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়। শুনানিকালে আসামিপক্ষে কোনো আইনজীবী পাওয়া যায়নি।
এদিকে বুধবার বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি (মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ) কার্যালয় থেকে আলোচিত দুই আসামিকে নিয়ে আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় পুলিশ। কঠোর নিরাপত্তার অংশ হিসাবে তাদের প্রিজনভ্যানে না তুলে সাদা মাইক্রোবাসে নেওয়া হয়। এ সময় মিন্টো রোড থেকে পুরান ঢাকার নিম্ন আদালত পর্যন্ত রাস্তায় বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্য ছাড়াও পথে পথে অবস্থান নেন সেনাসদস্যরা। পুলিশের গাড়িতে সতর্কতামূলক হুইসেল বাজানো হয়। সন্ধ্যার আগেই আদালত চত্বর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।
কানায় কানায় পূর্ণ : আইনজীবী, পুলিশ ও গণমাধ্যকর্মী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন বিক্ষুব্ধ সাধারণ জনতা। এতে আদালত চত্বর ছাড়িয়ে আশপাশের পুরো এলাকা লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সহস্র জনতার ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খায় পুলিশ। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে আদালত চত্বরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যুহ গড়ে তোলে সেনাবাহিনী। এছাড়া কৌশলগত পয়েন্টে বিজিবি (বার্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন।
অবশেষে সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে আসামি বহনকারী পুলিশের গাড়িবহর একে একে আদালত চত্বরে প্রবেশ করে। আসামি দুজন হলেও একাধিক প্রিজনভ্যান ও মাইক্রোবাস ঢুকতে দেখা যায়। এ সময় সালমান ও আনিসুল বিশেষ পুলিশ পাহারায় বসে ছিলেন পৃথক দুটি গাড়িতে। আসামিদের দেখে উপস্থিত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল, জুতা এবং ডিম ছুড়ে মারে বিক্ষুব্ধ জনতা। আসামিদের উদ্দেশে অনেকে ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার করেন। এমনকি উপস্থিত বিএনপিপন্থি আইনজীবীরাও নানা ধরনের স্লোগান দেন।
ভিড় ঠেলে রাস্তা থেকে আদালতে হাজতখানা পর্যন্ত মাত্র কয়েক গজ যেতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। একপর্যায়ে আসামিদের নিয়ে গাড়িবহর আদালত ভবনের পাশে হাজতখানায় (গারদে) প্রবেশ করে। এ সময় দুই আসামিকে স্বচক্ষে দেখার জন্য উৎসুক জনতা গারদের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। এতে পুলিশ, জনতা এবং আইনজীবীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ একত্র হয়ে ভিড় ঠেলে সরিয়ে দেয়।
কঠোর নিরাপত্তা : বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফের গারদের গেট খুলে যায়। এ সময় মাথায় হেলমেট এবং পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় দুই আসামি সালমান ও আনিসুলকে দেখা যায়। সেই প্রতাপশালী চেহারা ছাপিয়ে হেলমেটের আড়ালে তাদের দেখায় বিমর্ষ। এ সময় তাদের দুদিক থেকে ঘিরে আদালত ভবনের দিকে যেতে থাকে পুলিশ। উপস্থিত উৎসুক জনতা তুমুল হর্ষধ্বনি দেন। কেউ কেউ উল্লাসে ফেটে পড়েন। একসময় সালমানের মুখে সাদা লম্বা দাড়ি থাকায় তাকে অনেকেই দরবেশ বলে ডাকতেন। কিন্তু বুধবার আদালত চত্বরে তার মুখে দাড়ি দেখা যায়নি।
কাঠগড়ায় যেমন ছিলেন : ৬টা ৫৬ মিনিটে আসামিদের আদালত কক্ষে প্রবেশ করানো হয়। এরপর রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই সজিব মিয়া উল্লেখ করেন, এ মামলার বাদীর ছেলে শাহজাহান আলী (২৪) নিউমার্কেট থানাধীন বলাকা সিনেমা হলের গলির মুখে পাপোসের দোকানে কাজ করত।
১৬ জুলাই সকালে বাদীর ছেলে তার দোকানে কাজ করার জন্য আসে। সে সময়ে দেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অজ্ঞাতনামা আসামিরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তার রেলিং ভাঙচুর করতে করতে নিউ মার্কেটের দিকে এগিয়ে আসে। তারা রাস্তায় থাকা বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেয়। এ সময় ওপরে উল্লিখিত আসামিদের হুকুমে এবং ইন্ধনে অজ্ঞাতনামা আসামিরা শাহজাহান আলীর মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে।
এক পর্যায়ে অজ্ঞাতনামা আসামি বাদীর ছেলেকে গুলি করে। এতে ভিকটিম রাস্তায় পড়ে থাকলে উপস্থিত পথচারীরা ভিকটিম শাজাহানকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ধানমন্ডি পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে শাহজাহানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরে পপুলার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহজাহানকে পরীক্ষা করে ১৬ জুলাই মৃত ঘোষণা করেন।
শুনানিকালে নিহত শাহজাহান আলীর বাবা ইমাম হোসেন নিজেই কথা বলেন। আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত আমারও কিছু কথা আছে। আমি তাদের ফাঁসি চাই। এরা আমার ছেলের লাশ পর্যন্ত দেখতে দেয়নি। আমার ছেলেকে দাফনও দিতে পারিনি। এরা খুনি।’ তার কথা শুনে আদালত কক্ষে উপস্থিত বেশ কয়েকজন আইনজীবীকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আইনজীবীরা জানান, আসামিরা কাঠগড়ায় ছিলেন প্রায় ২০ মিনিট। এ সময় তারা কোনো কথা বলেননি। শুনানি শেষে আদালত কক্ষ থেকে বের করার সময় আসামিদের ওপর কয়েকজন আইনজীবী চড়াও হন। আসামিদের আঘাতের চেষ্টা করেন কেউ কেউ। পেছন থেকে সালমান ও আনিসুলের ঘাড়ে চড় দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগেই পুলিশ দ্রুত আসামিদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়। রাতে সালমান এবং আনিসুলকে ফের ডিবিতে নেওয়ার উদ্দেশে গাড়িতে তোলা হয়।
আদালত চত্বর কান্নাজড়িত কণ্ঠে এক আইনজীবী বলেন, এই আদালত চত্বরেই দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বিচারের নামে প্রকাশ্যে অবিচার চলেছে। সাবেক আইনমন্ত্রী অনিসুল হকের ইশারায় নিরপরাধ ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিচারকদের ফরমায়েশি রায় দিতে হয়েছে। অনেককে পুলিশি রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনও করা হয়েছে। কিন্তু আজ সেই একই আদালতে অপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে। দেশের কোটি মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এমন একটা দিন দেখার অপেক্ষায় ছিলেন।
অপর এক বিচারপ্রার্থী বলেন, সালমান ফজলুর রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ছিলেন। সরকারি প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু হাসিনার আমলে এসবের বিরুদ্ধে কারো টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আজ অবশেষে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জীবদ্দশায় এটা দেখতে পাওয়া নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।
বিদেশি মুদ্রা : শুনানিকালে আদালতকে পুলিশ জানায়, পলাতক অবস্থায় আনিসুল হকের কাছ থেকে তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে ১৭ হাজার ৫১২ ইউএস ডলার, ৭২৬ সিঙ্গাপুর ডলার। এর বাইরে তিনটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল) পাওয়া যায়।
এছাড়া সালমান এফ রহমানের কাছ থেকে ১২ হাজার ৬২৮ ইউএস ডলার, ৬২০ ফ্রাঁ, ৬ হাজার ৫০০ দিরহাম, উজবেকিস্তানের ১৩ লাখ মুদ্রা, ১৯ হাজার ৬৫০ রিয়াল, ৭৭৯ সিঙ্গাপুরি ডলার, ১৫০ পাউন্ড, ১ হাজার ৩২১ ইউরো, ভুটানের মুদ্রা ৬ হাজার ২৩০ রুপি, ৩ হাজার ২২০ থাই বাথ, বাংলাদেশি ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে সালমানের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা ছাড়াও পাওয়া যায় একটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ও একটি স্যাটেলাইট ফোন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসিনা সরকারের পলাতক মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে নানা জল্পনার মধ্যে মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ করে সালমান এবং আনিসুলকে গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ। রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতারের কথা জানান ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হাসান। পরে আটক অবস্থায় তাদের দুজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে সালমান এবং আনিসুলকে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরা অবস্থায় নৌকার পাটাতনে বসে থাকতে দেখা যায়। ছবিতে দুজনের হাত ছিল শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। আটকের পর তাদের আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট থানায় দায়েরকৃত হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের একপর্যায়ে সরকার পতনের একদফা কর্মসূচি দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন অনেকে। একপর্যায়ে নিরুপায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ৫ আগস্ট দুপুরে অতি গোপনে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এর পরপরই সরকারের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যান। পলাতক অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হক গ্রেফতার হন।