যে দলবাজি করবে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা : আসিফ

আসিফ আকবর

একবিংশ শতকের পহেলা বছর দেশের সংগীতাঙ্গনে সুনামির মতো আবির্ভাব ঘটে আসিফ আকবরের। এরপর টানা দীর্ঘদিন গানের বাজারে একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল তাঁর। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন কোণঠাসা ছিলেন ‘ও প্রিয়া’ গায়ক। দেশের ক্ষমতার পালাবদলে এবার নতুনভাবে সরব হচ্ছেন তিনি।

রাজনীতির পালাবদলের প্রসঙ্গ ধরে তাঁর গানের খবরও নিয়েছেন কামরুল ইসলাম।

গানের মানুষ আপনি, গান দিয়েই শুরু করি। কিছু দিন আগে ভারতে গিয়ে হিন্দি গান করেছেন। প্রকাশের পর ভিডিও নিয়ে ভক্তদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ দেখা গেছে।

এ নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা শুনতে চাই…
আমি আসলে হিন্দি ছবির গান করতেই গিয়েছিলাম। সেটা তো বললেই রিলিজ হয়ে যাবে না। ছবির কাজ শেষ হবে, তবেই গান আসবে। এর ফাঁকে কিছু মারাঠি, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কম্পানির সঙ্গে গান করেছি, তাঁদের আঞ্চলিক আবহের গান।

তাঁরা তাঁদের স্টাইলে ভিডিও বানিয়েছে। সব সময় ঐশ্বরিয়াকে চাইলে তো হবে না। ফেসবুকের কল্যাণে নেতিবাচক মন্তব্য কানে আসে। আগে ফেসবুক ছিল না, তাই ক্রিয়েশন হতো। এখন শুধু মন্তব্য প্রসব হয়, ক্রিয়েশন হচ্ছে না।

দেশে নতুন গান করছেন?
দেশের কোনো অডিও কম্পানির সঙ্গে সেভাবে কাজ করি না এখন। তারা আমাকে এফোর্ড করতে পারে না। বিদেশি কিছু কম্পানির সঙ্গে কাজ চলছে। ফ্রান্সের বিলিভ মিউজিকের সঙ্গে বড় আয়োজনে কয়েকটি গান করেছি। ওদের ব্যানারে পাকিস্তানের রাহাত ফতেহ আলী খান, ভারতের নিকিতা গান্ধী ও শ্রেয়া ঘোষালের সঙ্গে দ্বৈত গান করছি। এ ছাড়া কিংবদন্তি শিল্পী আশা ভোঁসলের সঙ্গেও একটি ডুয়েট গানের পরিকল্পনা হচ্ছে।

এবার রাজনীতি প্রসঙ্গে আসি। প্রায়ই আপনার মুখে নানা বঞ্চনা সহ্য করার কথা শুনেছি। এখন পরিস্থিতি কেমন?
২৪ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ১৮ বছর (তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ শাসনামল) আমি নেই। এখন তো খুশি থাকবই। স্টেজে গান করতে পারব। এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে ফিটনেস ধরে রাখতে হয়েছে। মনে আশা ছিল, কোনো না কোনো দিন সুযোগ আসবে। এখন বিদেশ ট্যুর শুরু করেছি। ইউরোপ ঘুরে এলাম, সামনে আমেরিকায় যাব। দেশেও শো শুরু হবে শিগগিরই।

ফেসবুকে তো আপনি বরাবরই প্রতিবাদী। এবার রাজপথেও নেমেছেন…
স্বৈরাচার কে বা কারা, আমরা তো চিনি। নতুন প্রজন্ম মাত্র চিনল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ কেমন ছিল আর শেখ হাসিনার এই ১৬ বছর কেমন ছিল, দেখলাম। আওয়ামী লীগ একটা অভিশাপের নাম। আগে থেকেই কথা বলে আসছি, শুধু সরকার না, যেকোনো অন্যায়-অসংগতি নিয়ে কথা বলেছি। এবার আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ৩ আগস্ট ঢাকা ফিরেই চলে গিয়েছি রবীন্দ্র সরোবরে, সংগীতশিল্পীদের প্রতিবাদে। ওখান থেকে গেলাম শহীদ মিনারে। আমার ছেলে রুদ্রকেও অফিশিয়ালি মাঠে নামিয়ে দিয়েছি।

রুদ্রকে নিয়ে অন্তর্জালে অনেক চর্চা হয়েছে। ওর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? 
ও তো জেনারেশন জেড-এর তরুণ। ২০১৮-তে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় পড়ত কলেজে। এখন ম্যাচিউরড হয়ে গেছে। আগে থেকেই ওরা আন্দোলন করে অভ্যস্ত। যা-তা বলে ওদের বোঝানো যাবে না। ঢাকায় ফিরে বাসায় গিয়ে দেখি ও পতাকা নিয়ে প্রস্তুত। পরে শহীদ মিনারে গিয়ে অফিশিয়ালি ওকে রাজপথে নামিয়ে দিয়েছি এবং ৫ আগস্ট পর্যন্ত ও মাঠে ছিল।

একজন প্রতিবাদী শিল্পীর দৃষ্টিতে এ আন্দোলন নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই…
এটাকে ধরা যেতে পারে ফরাসি বিপ্লব, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মতো। ছাত্রসমাজের সঙ্গে যখন জনতা মিশে যায়, তখন বোঝা যায় ওই স্বৈরাচার কতটা অন্তঃসারশূন্য ছিল। জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলীয়করণ করেছে। এসব দেখে দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু প্রতিবাদে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই প্রজন্ম সেটা পেরেছে। আমরা তাদের আনুগত্য স্বীকার করি। এই ছেলেগুলো আরো বড় হবে এবং দেশের নেতৃত্ব দেবে।

শিল্পীদের রাজনীতিতে জড়ানোটাকে কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখেন… 
শিল্পীদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মতো মানুষ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হয়েছেন, ভারত-পাকিস্তানের দিকে দেখেন, কত তারকা রাজনীতি করছেন। ব্যাপারটা হলো, আওয়ামী লীগের হয়ে রাজনীতি করলে ঠিক আছে, কিন্তু অন্য দল করলেই শিল্পীদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে তারা। শিল্পীরা রাজনীতির শুধু অংশই না, গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কিংবা ধরুন এবারের আন্দোলনে র‌্যাপাররা যে ভূমিকা রাখল, এগুলো অস্বীকারের সুযোগ আছে?

আবার গানে আসি। দেশে গানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। আগে যাঁরা গানে লগ্নি করতেন, তাঁদের মনোযোগ এখন নাটকে। এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?
প্রথমদিকে ইউটিউব থেকে গানের ভালো আয় হতো। এ কারণে সবাই ইউটিউবনির্ভর হয়ে গেছে। অথচ বিশ্বে আরো ১৭২টি প্ল্যাটফরম আছে, যেখানে গান প্রকাশ করা যায়। আমাদের প্রযোজকরা ইউটিউবনির্ভর হয়ে প্রথমদিকে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছিলেন, সে টাকা আর ওঠেনি। তাঁরা শোনার জন্য গান করেননি, দেখার জন্য করেছেন। যে কারণে ভিডিওতে ধস নেমেছে। এখন ভালো গীতিকার, সুরকার দিয়ে মানসম্পন্ন গান করতে হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমগুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। কারণ এখানে মুনাফা যেমন বেশি, তেমনি গানের সাউন্ড কোয়ালিটিও ঠিক থাকে।

অনেক কিছুর সংস্কারের কথা হচ্ছে। সংগীতাঙ্গনের কোন দিকটা সংস্কার জরুরি?
তিনটা সেক্টরে কাজ করা যেতে পারে। রেডিও ও টিভি চ্যানেলে গান পুনঃপ্রচারিত হয়, সেখান থেকে রয়্যালিটি আসতে হবে। আমাদের অনেক শিল্পী চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন। যথাযথ রয়্যালিটি পেলে তাঁরা একেকজন ৫০-৬০ কোটি টাকার মালিক হতেন। দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণ করা হয়েছে। আমরা একবার শিল্পকলায় ‘গানমেলা’ করেছিলাম, লিয়াকত আলী লাকী (শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক) সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ রকম প্রজেক্ট যদি করতে পারতাম, অনেক প্রতিভা তুলে আনতে পারতাম। এগুলোর চর্চা পুনরায় শুরু করতে হবে। তৃতীয়ত, দলীয়করণ বন্ধের জন্য একটা মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। যে-ই দলবাজি করবে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদের জন্য পেনশন স্কিমের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

LEAVE A REPLY