সম্ভাব্য যে ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখে তাঁরা পড়তে পারেন বলে ধরা হচ্ছিল, সাড়ে চার বছর আগের রাওয়ালপিন্ডি ঠিক সেই বিভীষিকাই উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাটারদের। প্রথম ইনিংসে সফরকারীদের ১০ উইকেটের সব কটিই নিয়েছিলেন পাকিস্তানের পেসাররা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির সেই টেস্ট মমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন দলের জন্য বয়ে এনেছিল ইনিংস এবং ৪৪ রানে হারের লজ্জাও। এত বছর পর একই শহরে ফিরতি যাত্রায় নতুন ইতিহাস লেখা হওয়ার চেয়েও ইমরুল কায়েস বড় প্রাপ্তি ধরছেন যেটিকে, সেটি পেস বোলিং দিয়ে পাল্টা স্বাগতিক দলের ব্যাটারদের ঘাবড়ে দিতে পারা।
ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত জাতীয় দলের সাবেক এই ওপেনার পেসারদের উত্থান থেকেই শুনেছেন নতুন আরো অনেক ইতিহাসের পদধ্বনিও। গত সন্ধ্যায় ফোনে এমন ঘোষণা দিয়ে ফেলতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করলেন না তিনি, ‘একসময় আমরাই শুধু পেস বোলিং ভীতিতে ভুগতাম। এবার আমরাই পেস দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের কাঁপিয়ে দিয়েছি। অবশ্য আমাদের ব্যাটাররাও ওদের পেসারদের দারুণ সামলেছে।
ব্যাটাররা রান করলে এই পেস আক্রমণ নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গিয়ে জেতা সম্ভব।’ অথচ সিরিজ শুরুর আগে বাংলাদেশের ২-০তে জেতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়ার লোকও ছিল না। এমন নয় যে দেশের বাইরে গিয়ে দুই টেস্টের সিরিজে প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার সাফল্য আগে ছিল না বাংলাদেশের। ছিল, তবে ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল ধর্মঘটে যাওয়া শীর্ষ খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতিতে জোড়াতালি দিয়ে গড়া একটি দল।
তাদের বিপক্ষে বিজয়ী বাংলাদেশ দলের ওপেনার ইমরুল অবশ্য এবার পাকিস্তানকে ‘ক্লিন সুইপ’ করার সঙ্গে তুলনায় আর কোনো সাফল্যকেই আনতে রাজি হলেন না, ‘এটি তো অবশ্যই এক নাম্বার। এই দুটো ম্যাচ আমাদেরই বড় দল বলে মনে করিয়েছে। প্রায় পুরোটা সময় আমাদের আধিপত্য ছিল।’
ইমরুলের মতো ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেটে ব্যস্ত মোহাম্মদ আশরাফুলের চোখে এই সিরিজে দেখতে পাওয়া নতুন ব্যাপারটি এ রকম, ‘একটি টেস্ট জিতলে পরেরটি আমরা হেরে যাই। তা-ও হারি বাজেভাবে।
এই প্রথম আমরা ছন্দ এবং আধিপত্য ধরে রেখে টানা দুটো টেস্ট জিতলাম। এভাবে দেখলে এটি অবশ্যই আমাদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য। যদিও মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে নিউজিল্যান্ডকে হারানোও কম বড় সাফল্য ছিল না। কিন্তু ওই যে, পরের টেস্টে আমরা খুব বাজেভাবে (ইনিংস ও ১১৭ রানে) হেরে গিয়েছিলাম।’ বাংলাদেশ দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদের হৃদয়েও আলাদা জায়গা নিয়ে আছে মাউন্ট মঙ্গানুই, তাই বলে এই সাফল্যকে তার পেছনে রেখে নয়, ‘মাউন্ট মঙ্গানুইকে এখনো এগিয়ে রাখব কন্ডিশনের কারণে। তবে সেরা সিরিজ জয় অবশ্যই এটি।’ বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কারণে টেস্ট থেকে নেওয়া লম্বা বিরতির পর এমন পারফরম্যান্স আরো বেশি তাক লাগিয়ে দিয়েছে মাহমুদকে, ‘আমরা তো টেস্টই খেললাম অনেক দিন পর। আন্ডারডগ ছিলাম। তা ছাড়া বিশ্বকাপও খুব ভালো যায়নি আমাদের। যে কারণে সিরিজ শুরুর আগে আমরা জিতব বললে যে কেউ কথাটি উড়িয়েই দিত। কিন্তু আমরাই ওদের উড়িয়ে দিলাম!’
উড়িয়ে দেওয়ার যে ছবিগুলো এক এক করে আঁকা হয়েছে, তা ইতিহাসের বাঁকবদল দেখিয়েছে বলে মনে করেন সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, ‘হ্যাঁ, এটিকেই আমাদের সেরা সাফল্য বলে মনে করছি। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট ওপরের সারিতেই থাকবে। যেহেতু ওই ধরনের কন্ডিশনে জেতা সব সময় কঠিন। এটি তাই আলাদা থাকবে। তবে এই টেস্ট সিরিজের মতো অতটা ধারাবাহিক আমরা আগে কখনো ছিলাম না। এক টেস্ট ভালো খেললে পরেরটিতে সাধারণত অত ভালো খেলি না আমরা। এই দুই টেস্টে আমরা চ্যালেঞ্জড যেমন হয়েছি, তেমনি সেখান থেকে সব সময় বেরিয়েও এসেছি। আমাদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন, শেষ বিকেলে ব্যাটিংয়ে নামলে দুই উইকেট পড়ে যায়।’ এটিকে সেরা সাফল্য বলার পেছনে হাবিবুলের অজস্র যুক্তির কিছু এ রকম, ‘ধারাবাহিকতা তো ছিলই, যখন যার দরকার পড়েছে, সে-ই দাঁড়িয়ে গেছে। এ জন্য এই সিরিজটি আমার কাছে বিশেষ কিছু। সাধারণত আমরা ভালো খেললে বলা হয় প্রতিপক্ষ ভালো খেলেনি। এবার সেটিও বলার সুযোগ কম। কারণ খারাপ খেলেনি পাকিস্তানও। কৃতিত্বটি বাংলাদেশকে দেওয়া উচিত। উই আউটপ্লেইড পাকিস্তান।’ আর সেটিও কিনা পেস দিয়ে তাদের ব্যাটারদের ঘাবড়ে দিয়ে!