নন্দিত থেকে নিন্দিত সালাউদ্দিন

কাঁধে উপচে পড়া ঝাঁকড়া চুল, মেদহীন শরীর—তরুণ কাজী সালাউদ্দিনের ছবির দিকে তাকিয়ে কিংবদন্তিকে অনুভব করা যায়। বাফুফে ভবনে তাঁর কক্ষের দেয়ালেই ঝোলানো পুরনো সেই ফ্রেম। ভরা স্টেডিয়ামের মাঝে দাঁড়ানো সেই সালাউদ্দিন কোটি মানুষের মন রাঙিয়েছেন! তাঁর অভ্যাস ছিল, মাঠে ঢুকে জুতার ফিতা বাঁধা। সেই ফিতা বাঁধতে তিনি ঝুঁকতেই গ্যালারিতে আলোড়ন পড়ে যেত!

দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম নিখুঁত স্ট্রাইকার প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে খেলেছেন এশিয়ার প্রথম পেশাদার লিগ হংকংয়ে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই ‘তূর্য’-এর অবদান কম নয়। তবে সংগঠক হিসেবে সেই সালাউদ্দিন যতটা না নন্দিত, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছেন নিন্দিত। চার মেয়াদে বাফুফে সভাপতি থাকার পর গতকাল নির্বাচনী রেস থেকে সালাউদ্দিনের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা সাদরেই গ্রহণ করেছে ফুটবলসমাজ। যদিও খবরটা চমক-জাগানিয়া।

গতকাল হুট করেই সালাউদ্দিন জানান, তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, তাঁর সঙ্গী-সাথিদের অনেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরও সালাউদ্দিনের পঞ্চম মেয়াদে নির্বাচন করার ঘোষণা বড় খবর ছিল। অঙ্ক মিলছিল না পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনী বৈতরণী কিভাবে পার হবেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সালাউদ্দিনই জানালেন, ‘আমি চার মেয়াদে আপনাদের সঙ্গে ছিলাম।

এই সুযোগ যে আমার জীবনে এসেছে, এ জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ২৬ অক্টোবর যে নির্বাচন আসছে, সেখানে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এটাই আপনাদের জানানোর জন্য এসেছি।’

সংবাদকর্মীরা প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু তিনি আগ্রহী নন।

শুধু এভাবে ঘোষণা দেওয়ার কারণ সংক্ষেপে জানিয়েছেন সালাউদ্দিন, ‘আমি চাই না কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হোক। কারো কোনো সংশয় যাতে না থাকে।’ বাইরের বা পারিবারিক কোনো চাপে এমন সিদ্ধান্ত কি না, সেটারও জবাব দিলেন না।

৫ আগস্টের পর সালাউদ্দিন এদিনই প্রথম বাফুফে ভবনে এসেছিলেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলার আধাঘণ্টার মধ্যে তিনি আবার বেরিয়েও যান। সেই ২০০৮ সালে নির্বাচন করে প্রথম তিনি সভাপতির পদে বসেন। তখন ফুটবলে পরিবর্তনের পক্ষে সোচ্চার সবাই। ঘরোয়া লিগ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এর আগে একবার ফিফার নিষেধাজ্ঞায় পড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সালাউদ্দিন ক্যারিজমেটিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে ফুটবল লিগ নিয়মিত করায় গুরুত্ব দিলেন। কোটি টাকার সুপার কাপ আয়োজন করে চমক জাগালেন। কিন্তু দিন গড়াতেই দেখা গেল, এর বাইরে তাঁর ঝুলিতে আর কিছু নেই। জেলা ফুটবলের উন্নতিকল্পে তিনি রূপকল্প দেবেন, এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু জেলার খেলায় গতি আসেনি। জাতীয় দল সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে এগোচ্ছে কি না, এটা নিয়ে সবাই সংশয়ে পড়ে গেলেন। কারণ মাঠের খেলা আর র‌্যাংকিংয়ে কোনো উন্নতির ছাপ দেখছিলেন না কেউ। এরই মধ্যে তিনি একেকটা নির্বাচনী বাধা পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০১২ সালে আব্দুর রহিম শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় সালাউদ্দিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলেন। ২০১৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কামরুল আশরাফ পোটন নিজেই ছিলেন বিতর্কিত। সালাউদ্দিন পার হয়ে গেলেন। সব শেষ নির্বাচনে নানামুখী চাপে তরফদার রুহুল আমিন ও বাদল রায়ের সরে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সালাউদ্দিন অনেকটা একা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ফুটবল সমর্থক গ্রুপ এবং অনেক সাবেক ফুটবলার তাঁর নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন বরাবর। তাতে সালাউদ্দিন নিজ গৃহে অনেকটা স্বেচ্ছাবন্দি হয়েছিলেন। সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হলেন তিনি অবশেষে, তবে সেটা ১৬ বছরের সাম্রাজ্য ছেড়ে নির্বাসনে গিয়ে!

LEAVE A REPLY