পাহাড়ে সংঘর্ষে নিহত ৪

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি দফায় দফায় সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এ সময় শতাধিক দোকানপাট, বাড়িঘর ও গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও রাঙামাটি শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এ নিয়ে পরস্পরকে দুষছে দুপক্ষ। 

ঘটনার সূত্রপাত খাগড়াছড়িতে। সেখানে বুধবার মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার বিকালে দুপক্ষের সংঘর্ষ বাধে। রাতভরও দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে তিনজন নিহত হন। শুক্রবার এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। সেখানে কয়েক দফা হামলা-সংঘর্ষে আরেকজন নিহত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে বান্দরবানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। 

তিন পার্বত্য জেলার সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইএসপিআর। আজ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শনে যাবেন। 

এদিকে পাহাড়ে হামলা, হত্যা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। রাজধানী ঢাকায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতা’। শুক্রবার দুপুরে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। যুগান্তর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খাগড়াছড়ি : মামুনকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকালে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি লারমা স্কয়ারের দিকে যাওয়ার সময় দুপক্ষের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে লারমা স্কয়ারে দোকানপাট ও বসতবাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর জের ধরে ওইদিন রাতভর জেলা সদরে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়েছে। এ সময় সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাতের গোলাগুলি ও বিকালের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। 

নিহতরা হলেন-জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। এর মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা বিকালের সংঘর্ষে মারা গেছেন। অপর দুজনকে আহত অবস্থায় রাতে সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, আহতদের অনেকেই হাসপাতালে এসেছেন। এরমধ্যে তিনজন মারা গেছেন। তাদের লাশ মর্গে রয়েছে। 

সহিংসতা ও নাশকতা রোধে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের সহিংসতা রোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার সকালে দীঘিনালা লারমা স্কয়ারে যান জেলা প্রশাসক, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওমর ফারক। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত দোকানপাট পরিদর্শন করেন তারা। পরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। 

এ সময় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসক সহিদুজ্জামান বলেন, ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য পাহাড়ি-বাঙালি উভয়কে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ করছি। গতকালের আগুনে অন্তত ১০২টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে। তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। 

লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওমর ফারুক বলেন, দীঘিনালার পরিস্থিতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত আছে। 

রাঙামাটি : শুক্রবার সকালে শহরে পাহাড়িদের একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে বনরূপা এলাকায় ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। এর জের ধরে বনরূপা, হ্যাপিরমোড়, কাঁঠালতলী, কালীন্দিপুর, বিজন সরণি, নিউ কোর্ট বিল্ডিং এলাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অফিস এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় সংঘর্ষে একজন নিহত ও শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে গুরুতর কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শওকত আকবর খান। 

তিনি বলেন, সংঘর্ষের পর মৃত অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন বাড়িঘর ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেলসহ ১৫-১৬টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। শহরসহ গোটা জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করায় বিকালের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, খাগড়াছড়ির ঘটনা নিয়ে সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। তাই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এটি বলবৎ থাকবে। শহরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্রবার এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফের সহসভাপতি নতুন কুমার চাকমা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

বান্দরবান : পাহাড়ে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে বান্দরবানে পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেছে। শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজারমাঠ থেকে সম্মিলিত ছাত্র সমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড হাতে শত শত শিক্ষার্থীর মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে প্রেস ক্লাবের সামনে মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সভাপতি অংশৈসিং মারমার সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন-বিটন তঞ্চঙ্গ্যা, টনায়া ম্রো, জন ত্রিপুরা, মাখাই মারমা, অনন্ত প্রমুখ।

ঢাকা : ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতা’। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এর আগে তারা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করেন। এ সময় তারা পাহাড়িদের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। বেলা পৌনে ১২টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ের দিকে যান। প্রায় ২০ মিনিট তারা শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের হাতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। 

এদিকে বিকালে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষার্থী সমাজের ব্যানারে’-ভারতীয় মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থির করার লক্ষ্যে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ বাঙালিদের হত্যা, মসজিদে হামলা, লুটপাট বন্ধ ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে একদল শিক্ষার্থী। 

এ সময় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হলো-পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে; অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে; নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা জায়গাগুলোতে সেনা ক্যাম্প বাড়ানো ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অসাংবিধানিক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে।

LEAVE A REPLY