যে গানে আজও জীবন্ত রুদ্র

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানের স্রষ্টা তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আজ ৬৮তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের কবিতায় অবিস্মরণীয় এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। বেঁচে থাকলে জীবনের ৬৯ শরতে পা রাখতেন। স্বভাবসুলভ উদাসীনতায় হয়তো দিনটা বিশেষভাবে উদযাপনও করতেন না।

তবু পঞ্জিকায় অক্টোবর এলে, বিদায়ের প্রান্তে আসা শরতে রুদ্র একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন ভক্ত-পাঠক মনে। কবিতায় রুদ্র যেমন অনিবার্য এক নাম, তেমনই রুদ্রকে বাংলা গানের শ্রোতারা মনে রেখেছে মোটাদাগে একটি গানের জন্য—‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ 

আশির দশকের শেষদিকে গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন রুদ্র। রচনার পর গানটি কাছের বন্ধুদের শুনিয়েছিলেন কবি।

এক কান দুই কান করে বহু প্রাণে দোলা দিয়েছিল এটি। তবে গণমানুষের কাছে পৌঁছায় ১৯৯৬ সালে, মতিন রহমানের ‘তোমাকে চাই’ চলচ্চিত্রের সুবাদে। এই ছবিতে পূর্ণাঙ্গ সংগীতায়োজনে গানটি ব্যবহৃত হয়। সংগীতের কাজটা সামলেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

পর্দায় সালমান শাহ ও শাবনূরের রসায়ন, অন্তরালে এ গানের কথা-সুর; ছড়িয়ে যায় দেশজুড়ে। যদিও চিরায়ত স্বভাবে গ্রামগঞ্জের সিংহভাগ মানুষ গীতিকারের নামে ভ্রূক্ষেপ করেন না। তবু গানটি যখন যার কানে বেজেছে, হৃদয়ে দোলা দিয়েছে, তাঁর কাছেই তো অমরত্বের অদৃশ্য ছায়া হয়ে পৌঁছে গেছেন রুদ্র।

এ গানের আবেদন পশ্চিমবঙ্গেও প্রবল। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী কবীর সুমনের অত্যন্ত প্রিয় গান এটি।

বিভিন্ন সময়ে লাইভ পারফরম্যান্সে গানটি পরিবেশন করেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘১৩’ অ্যালবামে গানটি দ্বৈত গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে। একবার গানটি গাওয়ার ফাঁকে সুমন বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথকেও ঈর্ষা করি না। আমি ঈর্ষা করি লালন ফকির, হাসন রাজা, কবি জসীমউদ্দীনকে। আর এই লোকটাকে, যে এই দুটি লাইন [ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো] লিখে গিয়েছিল।’

চলচ্চিত্রে ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর ও কনকচাঁপা। রচয়িতা, সংগীতায়োজক ও পুরুষ কণ্ঠশিল্পী—সবাই চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তাই এ গানের পেছনের গল্প জানতে যোগাযোগ করা হয় কনকচাঁপার নম্বরে। ফোন রিসিভ করেন তাঁর জীবনসঙ্গী—সুরকার মইনুল ইসলাম খান। তিনি জানান, গানের শুটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন শিল্পী। তবে খান কিছু তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘গানটি রেকর্ডের সময় আমিও ছিলাম। আসলে অন্যান্য গানের মতোই এটার প্রস্তাব এসেছিল, এরপর গেয়েছে ও (কনকচাঁপা)। ইনফ্যাক্ট গাওয়ার পর ও জানতে পারে যে এটা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা। কিন্তু গান তৈরির সময় বা আগে কবির সঙ্গে কখনো দেখা-আলাপ হয়নি।’  

গানের সঙ্গে রুদ্রের সখ্য ছোটবেলা থেকেই। সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকেই তিনি গান রচনা করতেন। তবে গান নিয়ে সেভাবে অগ্রসর হননি। যেমনটা শেষ জীবনে হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি চলে গেছেন বলে শেষ জীবনে তকমা দেওয়া হচ্ছে। আদতে জীবনের টগবগে যৌবনেই তিনি গানমুখী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল এ ক্ষেত্রে তাঁর বড় অনুপ্রেরণা ছিল। তাঁরা যেমন গান রচনা করে গেছেন, রুদ্রও চেয়েছিলেন গানের মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো ছড়িয়ে দিতে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর বন্ধু কথাসাহিত্যিক ইসহাক খানের এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, বাগেরহাটে নিজের গ্রাম মিঠেখালিতে ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ লিখেছিলেন কবি। প্রায় ছয় মাস ঢাকা থেকে ডুব দিয়ে সেখানে ছিলেন কবি। ওই সময় একটি গানের দল করেছিলেন রুদ্র। যেটাতে তিনজন সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁদের ঢাকায় এনে প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনাও ছিল কবির। তা আর বাস্তব হয়ে ওঠেনি।

রুদ্রের আরো অনেক গান রয়েছে। তবে প্রকাশিত গানের সংখ্যা হাতেগোনা। ১৯৮৫ সালে কিশোরী শবমেহেরকে জোরপূর্বক নারায়ণগঞ্জ টানবাজার পতিতাপল্লীতে এনে নির্মম অত্যাচারে হত্যা করা হয়। ওই কিশোরীকে নিয়ে একটি গানের ক্যাসেট করেছিলেন ফকির আলমগীর। সে ক্যাসেটেই ছিল রুদ্রের লেখা চারটি গান। যার একটির কথা এ রকম—‘জীবনডারে কোন জীবনে থুই ভাঙাচোরা মন।’

এ ছাড়া ১৯৮৭ সালে প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবের জন্য গান ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’ রচনা করেন রুদ্র। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনকে নিয়েও একটি গান লিখেছিলেন রুদ্র। দুটিই গেয়েছিলেন ফকির আলমগীর।

অপ্রকাশিত আরো কিছু গানের খোঁজ দিয়েছিলেন কবির বন্ধু, কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান। এর মধ্যে রয়েছে ‘দিন গেল দিন গেলরে ও দিন গেলরে, মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করা আর হইল না’; ‘ছিঁড়িতে না পারি দড়াদড়ি’, ‘আমরা পাড়ি দেব রুদ্র সমুদ্র কালো রাত’ ইত্যাদি। এসব গান ছিল তাঁদের আড্ডার প্রাণ। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ আয়োজনে সেগুলো সাধারণ শ্রোতার কান অব্দি আর পৌঁছায়নি। আর কখনো পৌঁছাবে কি না, তাও বলা মুশকিল।

LEAVE A REPLY