রেড নোটিশ নাকি প্রত্যর্পণ চুক্তি? কিভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব

জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনবে সরকার।

রবিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

এর আগে গত অক্টোবরে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের গ্রেপ্তার করে আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

ইন্টারপোলে রেড নোটিশ দিয়ে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের কবে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ কিংবা ভারতে পলাতকদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা সম্ভব কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফরমালি আমাদের পক্ষ থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু চলে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরে।’

গত মাসেই ভারত সরকার নিশ্চিত করে জানিয়েছে যে শেখ হাসিনা তাদের দেশেই অবস্থান করছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই।

তাহলে বাংলাদেশ কেন সেই চুক্তি অনুযায়ী ফেরত না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রেড নোটিশ জারি করে কিভাবে ফেরত আনা যায়?

অক্টোবরের ১৭ তারিখ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‌‘বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারপোল আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে জানার পর সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রেড এলার্ট মানে অমুক লোক, এর বিরুদ্ধে আমাদের এখানে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে। ওই আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের পুলিশ বিভাগকে ওই আসামির ওপর নজর রাখতে বলবে।’

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত আনা গেছে।

এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোল যদি সহযোগিতা করে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল হুদা কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।তিনি বলেছেন, ‘ফেরত পাঠানোর বিষয়টা শুধু রেড নোটিশের মাধ্যমেই সম্ভব হয় না। সেটা সেই দেশের জুডিশিয়াল অথরিটিরও বিষয় রয়েছে।’

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফেরত আনা সম্ভব?

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে তাদের রেড নোটিশের তালিকায় বর্তমানে ৬৪ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি।

এর আগে ২০১৫ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে ইন্টারপোল ওই বছরের ২ জুলাই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। পরে এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামেন তারেক রহমানের আইনজীবীরা। পরে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ইন্টারপোলের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রেড নোটিশের তালিকা থেকে তারেক রহমানের নাম প্রত্যাহারের আদেশ দেয় ইন্টারপোল কমিশন। বর্তমানে ইন্টারপোলের তালিকায় যে ৬৪ জনের নাম রয়েছে, তার মধ্যে তারেক রহমানের নাম নেই।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলে কাউকে রেড এলার্ট দিলেই যে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে বিষয়টি একেবারেই তেমন নয়।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাকে যে দেশে নেওয়া হবে সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন। কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না সেগুলোও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।’

এর আগে ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার পর আযাদ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। তাকে ফেরত আনতে রেড এলার্ট জারি করেছিল ইন্টারপোল।

ইন্টারপোলের তালিকায় এখন যে ৬৪ জনের নাম আছে, সেখানে আবুল কালাম আযাদের নামও দেখা গেছে। কিন্তু আযাদকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।

ইন্টারপোল কিভাবে কাজ করে?

ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেটি সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ও সমন্বয় করে। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। যেন বিশ্বের সব পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করতে পারে।

যদি একটি দেশের আসামি সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই আসামিকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে। সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডাটা বিশ্লেষণ, সেই সঙ্গে পলাতকদের খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়।

তবে ইন্টারপোল কোনো আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো দেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আবেদন জানায়, তাকে ওই অভিযুক্তের অপরাধ বিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলার কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে দিতে হয়।’

ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে তার বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করা হবে কি হবে না। এ ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়। 

ইন্টারপোল কারো বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়।
মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেইস রয়েছে, যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন- অপরাধীর ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন এবং জালিয়াতির তথ্য ইত্যাদি পাওয়া যায়।

দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার, অস্ত্রপাচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।

রেড নোটিশ নাকি প্রত্যর্পণ চুক্তি?

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই। চুক্তি অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয়, তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত।

এই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যেকোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, সেটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০-এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।”

গত মাসেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকার পরও শেখ হাসিনাকে সেই চুক্তি অনুযায়ী না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা কেন চাওয়া হচ্ছে?

এমন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যর্পণ চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। আর ইন্টারপোলের মাধ্যমে দ্রুত কাউকে ফেরত পাওয়া সম্ভব। শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য যত প্রক্রিয়া আছে সব প্রক্রিয়াই ফলো করবে সরকার।’

তবে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় কোনো দেশ যদি কোনো আসামিকে ফেরত দিতে না চায়, তাহলে যেকোনো কারণ দেখিয়ে আবেদন নাকচ করে দিতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মোটা দাগে বললে প্রত্যর্পণ চুক্তি বাস্তবায়ন করার বিষয়টি শুধু আইনি বিষয় নয়, রাজনৈতিকও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের জায়গা থেকে শেখ হাসিনাকে চুক্তি কিংবা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা জটিল।’

LEAVE A REPLY