বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে ৪০০ কোটি ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা) বেশি। এ ছাড়া দেশে ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসম্মত সেবা পায় না। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর মতিঝিলে চেম্বারের সম্মেলনকক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেবা নিয়ে থাকে এবং ২০১২ সালে বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ায় বাংলাদেশিদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় চার বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার।
মালিক তালহা আরো বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রাহক সন্তুষ্টি শুধু চিকিৎসা থেকে আসে না বরং পুরো হাসপাতালের ইকোসিস্টেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিদেশি ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস দেশে আসার প্রক্রিয়া আরো সহজতর করতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ডব্লিউটিওর তথ্য মতে বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না, সেই সঙ্গে স্থানীয় সেবায় প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান না থাকায় বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার প্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে উন্নত অবকাঠামো ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বাজেট সহায়তা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক হাসপাতালগুলোর চেইন কার্যক্রম বাংলাদেশে চালুকরণ, বিদেশি ডাক্তার ও নার্সদের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আশরাফ আহমেদ বলেন, ক্রমবর্ধমান হারে মধ্যবৃত্ত পরিবারগুলো সম্প্রতি বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে যাচ্ছে, যদিও অনেক চিকিৎসা স্থানীয়ভাবেও পাওয়া যায়। তিনি আরো বলেন, রোবোটিক সার্জারির মতো স্থানীয়ভাবে চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব হলেও তুলনামূলকভাবে কম আত্মবিশ্বাস এবং গ্রাহকদের সন্তুষ্টির অভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে খান আজাদ বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থার স্বল্পতা, সর্বোপরি কমফোর্টের অভাবে অসংখ্য লোক দেশের বাইরে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। এগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখিতা হ্রাস করা সম্ভব।
দেশের ল্যাবরেটরিগুলোর মান উন্নয়নের কথা উল্লেখ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি সর্বদা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, এমতাবস্থায় বর্তমানে আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি আগামী ২৫ বছর পর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, তাই সেরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি গ্রহণ করার জন্য আমাদের একটি সঠিক পাঠ্যক্রম থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন বলেন, বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি, যার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমবে, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের মাধ্যমে রিজার্ভ বৃদ্ধি সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মেডিক্যাল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্সের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, শুধু স্বাস্থ্য প্রশাসনকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য সিভিল সার্ভিস থেকে বাদ দিয়ে পৃথক স্বাস্থ্য ক্যাডারের প্রস্তাব করেন।
পাশাপাশি এ খাতকে আরো কার্যকর করতে জুডিশিয়ারি সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্যসেবা কমিশন গঠনের ওপর জোর আরোপ করেন।
দক্ষ জনশক্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে উল্লেখ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সের সেক্রেটারি ডা. আবুল বাসার মো. জামাল বলেন, বাংলাদেশে এক লাখ ৩৪ হাজার চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে মাত্র ৩৩ হাজার সরকারি চিকিৎসক। তবে এটা সন্তোষজনক যে এখানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।
ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।