প্রতীকী ছবি
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ফরাদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আলী। পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে চলতি বছর ৩০ জুন সৌদি আরব যান তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দুই মাস ১৮ দিনের মাথার গত ১৭ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে আসতে হয় তাঁকে।
কালের কণ্ঠকে আব্দুল্লাহ আলী বলেন, ‘ভিটা-বাড়ি বন্দক রেখে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে, গরু-ছাগল বিক্রি করে সৌদি আরব গিয়েছিলাম।
কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি কাজ নেই। ২২ দিন আমাকে একটি হোটেলে আটকে রাখা হয়েছিল। এরপর এক বাসায় গাড়ি চালানোর কাজ দেয়। কিন্তু এক মাস কাজ শেষে বেতন দেয় মাত্র ৩০০ রিয়াল (৯ হাজার ৫৮০ টাকা)।
আরো পড়ুন
কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রশাসন, খুশি অন্য ক্যাডাররা
বিষয়টি আমার এজেন্টকে জানালে উল্টো আমাকে হুমকি দেয় সে। বলে, যে কাজ দিয়েছি সে কাজ করবেন নইলে দেশে পাঠিয়ে দেব। এদিকে দেশের দালালকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফোন করলে ধরে না সে।
এভাবে আরো ১৫ দিন কাটে। শেষে কোনো উপায় বের করতে না পেরে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসি। এখন আমি পুরো নিঃস্ব। কিভাবে ভিটা-বাড়ি ফিরে পাব তা-ও জানি না।’
আব্দুল্লাহ আলীর মতো অসংখ্য কর্মী প্রবাসে গিয়ে কাজ না পেয়ে তিন থেকে ছয় মাসের মাথায় স্বপ্নভঙ্গ হয়ে দেশে ফিরে আসছেন।
তবে এভাবে কত কর্মী দেশে ফেরত আসছেন তার সঠিক তথ্য নেই বাংলাদেশ সরকারের কাছে। ২০২৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ছয় মাসের মধ্যে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য ৫০ হাজার টাকা বীমা সুবিধা চালু করেছিল।
সে বীমা সুবিধার আবেদনের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, গত দুই বছরে বিশ্বের ১২টি দেশ থেকে এক হাজার ৯২৬ জন বাংলাদেশি কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন, যার মধ্যে চলতি বছর ফেরত এসেছেন এক হাজার ২০০ জন। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ৩৭ শতাংশ বেশি কর্মী ফেরত এসেছেন। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে আউটপাস নিয়ে ফেরত এসেছেন ৪০ হাজার ৩০৫ জন কর্মী।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কর্মীদের বড় একটি অংশ কাজ না পেয়ে ফেরত এসেছেন। তবে সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। আর চলতি বছর মালয়েশিয়ায় অভিবাসন প্রত্যাবাসন কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশে ফিরে আসতে ৩১ হাজার ৪১ জন বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধন করেছেন। গত ১২ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক জাকারিয়া শাবান।
কাজ না পেয়ে কর্মীদের দেশে ফিরে আসার পেছনে দূতাবাসের ব্যর্থতা রয়েছে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, দূতাবাসের সত্যায়নের ওপর ভিত্তি করে কর্মী পাঠানো হয়। তাহলে এই কর্মীরা কেন কাজ পাবেন না?
আর দূতাবাস বলছে, কম্পানি যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকে না। কিন্তু কোনো কম্পানি ১০০ কর্মী নেওয়ার কথা জানালে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা ৩০০ কর্মী পাঠান। তখন বেশির ভাগ কর্মী কাজ পান না।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দূতাবাসের জনবলসংকটে অনেক সময় কর্মীরা প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হন। তবে কোনো কর্মী কাজ না পেলে অভিযোগ করলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দূতাবাস। এ ছাড়া কাজ না পেয়ে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য বীমা সুবিধাসহ পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ বুধবার সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব অভিবাসী ও জাতীয় প্রবাসী দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রবাসীদের অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার/বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, আমাদের সবার’।
বীমা সুবিধায় দুই বছরে ফিরেছেন ১ হাজার ৯২৬ জন কর্মী
কাজ না পেয়ে ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বীমা সুবিধা চালু করেছে। এই বীমা সুবিধা পেতে আবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত দুই বছরে ১২টি দেশ থেকে এক হাজার ৯২৬ জন কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন।
ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী ফেরত এসেছেন সৌদি আরব থেকে। দুই বছরে সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছেন ৭৭৬ জন কর্মী। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। চলতি বছর গত ৩১ মে ওই শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশটি থেকে দুই বছরে ফেরত এসেছেন ২২১ জন প্রবাসী বাংলাদেশি। এরপর ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির শ্রমবাজার থেকে গত দুই বছরে ফেরত এসেছেন ২২০ জন কর্মী। এর মধ্যে দেশটির প্রদেশ দুবাই থেকে ফেরত এসেছেন ১৫৩ জন কর্মী। আর আবুধাবি থেকে এসেছেন ৬৭ জন কর্মী।
এ ছাড়া ওমান থেকে ২১৬ জন, কাতার থেকে ১২২ জন, সিঙ্গাপুর থেকে ৮৭ জন, রুমানিয়া থেকে ৮৭ জন, কুয়েত থেকে ৭৪ জন, কিরগিজস্তান থেকে ৫২ জন, উজবেকিস্তান থেকে ৪৩ জন ও কাজাখস্তান থেকে ২৮ জন কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন।
কর্মীদের ভোগান্তির জন্য দূতাবাসের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কর্মীদের কাজ না পাওয়ার পেছনে দূতাবাসের বড় ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে। দূ
তাবাস থেকে সত্যায়নের মাধ্যমে কম্পানিতে কর্মী পাঠানো হয়। ফলে কর্মী যখন কাজ পাচ্ছেন না তখন দূতাবাসের যাচাই-বাছাই ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে যে কম্পানিগুলো সমস্যা তৈরি করছে, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।’
তবে দূতাবাসগুলো এই অভিযোগ মানতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালয়েশিয়া দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মালয়েশিয়ায় এসে কাজ পাচ্ছেন না, এ রকম ঘটনা রয়েছে। তবে তা অনেক বেশি নয়। অনেক সময় দেখা যায় কর্মীরা যে কম্পানিতে আসছেন সে কম্পানি অনেক বেশি কর্মী নিয়ে আসছে। যার ফলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘আমাদের শ্রমবাজারে কার্যকরী কোনো চুক্তি নেই। এখন আমাদের প্রয়োজন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বিষয়টি নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি দূতাবাসগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে দূতাবাসগুলো কর্মীদের ভোগান্তির ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’