টনি হেমিং
সম্পর্কটি শেষ হয়েছে তিক্ততায়। শিগগিরই সেটি জোড়া লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু কথায় কথায় জানতে চাওয়া হয়, আবার সুযোগ এলে তিনি বাংলাদেশে ফিরবেন কি না। ‘অবশ্যই ফিরব’, টনি হেমিং যেভাবে জোর দিয়ে কথাটি বললেন, তাতে একটু খটকা লাগা স্বাভাবিক।
পরক্ষণেই অবশ্য এই অস্ট্রেলিয়ান মৃত্তিকা ও উইকেট বিশেষজ্ঞ যাবতীয় অস্পষ্টতা দূর করে দিলেন। জানালেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চাকরি ছেড়ে আসার আগে অন্য এক সম্পর্কের টান গভীর করে এসেছেন তিনি, যা বারবার তাঁকে একটি বিভাগীয় শহরে ফিরে যেতে মরিয়া করে রেখেছে, ‘বাংলাদেশে তো আমাকে যেতেই হবে। সময়-সুযোগ পেলেই চলে যাব। ওখানে আমার মেয়ে আছে না!’
অদ্ভুত উচ্চারণে নিজের মেয়ের নামটিও বললেন হেমিং।তবে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে নাম এবং অন্যান্য বিস্তারিত গোপন রাখা হলো। নিজের ব্যক্তিজীবন নিয়ে অবশ্য ভীষণ খোলামেলা হেমিং। জানালেন, তাঁর প্রথম বিয়েটি টেকেনি। ওই পরিবারে তাঁর দুই ছেলে আছে।
দ্বিতীয় বিয়েও তাঁকে একজন করে পুত্র ও কন্যা সন্তান উপহার দিয়েছে। চারজনের বাবা বাংলাদেশে গিয়ে সন্তানের সংখ্যা আরেকজন বাড়িয়েছেন এভাবে, ‘এই মেয়েটিকে আমি দত্তক নিয়েছি।’
বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভিনদেশিদের দত্তক নেওয়ার ঘটনা ভূরি ভূরি। বিদেশিরা সাধারণত নবজাতক থেকে কম বয়সী শিশুদের অভিভাবকত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রেই উৎসাহী হন বেশি। এই প্রতিবেদকও সে রকমই ভাবছেন জেনে ভুলটা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দিলেন হেমিং, ‘আমার মেয়ে কিন্তু ছোট নয়, বেশ বড় হয়ে গেছে।ওর বয়স এখন ২০ বছর।’
বিসিবির কিউরেটর এডুকেটর হিসেবে টনি হেমিং কাজে যোগ দিয়েছিলেন ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। পরের বছরের জুলাইয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার অভিযোগ তুলে চাকরি ছাড়া মাত্রই তাঁকে নিয়ে নেয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। এখানকার চিফ কিউরেটর বাংলাদেশে এক বছর দায়িত্ব পালনকালে দেখা পান তাঁর দত্তক নেওয়া মেয়ের।
তত দিনে সে প্রাপ্তবয়স্ক। আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের উইকেট তদারকি করতে সিলেট গিয়ে মেয়ের কর্মস্থলেই তাঁদের প্রথম দেখা, ‘ও সিলেটের একটি হোটেলে কাজ করে। ওখানেই ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এখনো সে ওই হোটেলেই আছে।’ পরিচয় থেকে সম্পর্কটি কিভাবে বাবা-মেয়ের দিকে এগোল, বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের আগের দিন রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই গল্প শুনিয়েছেন হেমিং, ‘টেস্ট ম্যাচের উইকেট প্রস্তুতি দেখভাল করতে গিয়ে সিলেটের ওই হোটেলে তিন সপ্তাহ ছিলাম আমি। সেখানে প্রতিদিন ব্রেকফাস্টের সময় ওর সঙ্গে কথা হতো আমার। একদিন জানাল, সে এতিমখানায় বড় হয়েছে। মা-বাবাহারা মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো আমার।’
আরো গভীরে ঢুকে অন্য রকম ভালো লাগায়ও আচ্ছন্ন হয়ে যান হেমিং, ‘পরে জানলাম, ওই হোটেলে আমার মেয়ের ম্যানেজারও একজন এতিম। এতিমখানা থেকে হোটেলে এতিমদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না?’ প্রতিদিন সিলেটের হোটেলের সেই নারী কর্মীর সঙ্গে আলাপ করতে করতে নিজের মেয়ের কথাও মনে পড়ত হেমিংয়ের। ঠিক এই জায়গা থেকেই আসে দত্তক নেওয়ার চিন্তা, ‘একই সময়ে মেলবোর্নে থাকা আমার মেয়েকে আমি ভীষণ মিস করতাম। সে-ও বড় হয়ে গেছে, বাবার সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় না। তখনই এই মেয়েটিকে সহায়তা করার চিন্তা মাথায় এলো।’
তাতে হেমিংয়ের দত্তক নেওয়া মেয়ের জীবনেও লাগে পরিবর্তনের হাওয়া, ‘আমি ওকে পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছি। দিয়েছি আর্থিক সহায়তা। প্রতিদিনই ওর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। ওকে বলেছি, কোনো কিছুর দরকার পড়লে কিংবা কোনো সমস্যায় পড়লে যেন আমাকে জানায়। তা ছাড়া সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় সুবিধা হয়েছে যে ওকে দত্তক নিতে গিয়ে আইনি কাগজপত্রের কোনো দরকার হয়নি। ভালো মানুষকে কষ্ট করতে দেখে মনে হয়েছিল, আমি ওর পাশে থাকি। এখন তো আমি ওর সৌভাগ্যবান বাবাও।’ এমন আদরের মেয়ের কাছে তো বাবা ফিরবেনই একদিন!