অগণিত কালজয়ী গানের স্রষ্টা শেখ সাদী খান। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এ সুরকার ও সংগীত পরিচালক এখন ৭৬ বছরে। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গান করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক।
সম্প্রতি খবর বের হয়েছে তাকে বিটিভি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যা নিয়ে আক্ষেপের কথা শুনিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তী এই সুরকার।
জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত কণ্ঠশিল্পীরা বিটিভিতে এখন আর তেমন প্রগ্রাম পাচ্ছেন না। পাশাপাশি প্রগ্রামগুলোর মানও তেমন ভালো হচ্ছে না।
আমি বিটিভির এসব নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে বিগতদিনে বিভিন্ন সময় জোরাল প্রতিবাদ করেছি, এখনও করছি। আর এ কারণেই মূলত বিটিভির একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান থেকে অন্যায়ভাবে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যা এ বয়সে আমার জন্য খুবই অপমানজনক।’
শেখ সাদী খান বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সুরসম্রাট বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভ্রাতুস্পুত্র ও সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর পুত্র।
আজ সন্ধ্যায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘এমন ঘটনার পর বয়স কম হলে, দেশ ছেড়ে চলে যেতাম! কারণ, অন্যায় অনিয়মের বিপক্ষে কথা বললে এমনই হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘এটা বোধহয় বিটিভির সংবিধানে আছে। বিগত সময়েও শিল্পীদের পেছনে নানা রকম সিল মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কী দারুণ সব কারবার। কী আর করব, জন্মেছি এ দেশে, তাই ভালোবাসি দেশকে।
এই মাটির গন্ধই আমাকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সবাইকে ভালো রাখুন, আমীন।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শত শত জনপ্রিয় গানের সুরকার শেখ সাদী খান। বিটিভি থেকে বাদ পড়ার পর প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে শেখ সাদী খানের পরিকল্পনা ও সঙ্গীত পরিচালনায় বিটিভিতে সঙ্গীত বিষয়ক পুরনো দিনের বাংলা গান নিয়ে ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানের প্রচার শুরু হয়। এ অনুষ্ঠানে গবেষক হিসেবে প্রখ্যাত গীতিকবি মুন্সী আবদুল ওয়াদুদ এবং আলোচক ও বিশ্লেষক হিসেবে আরেক প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদি শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছেন।
শেখ সাদী খান অভিযোগ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি কিছু না জানিয়েই গত ৯ বছরে দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠা স্মৃতিময় গানগুলো নামক প্রগ্রামটি থেকে এর মূল পরিকল্পনাকারী ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আচমকা আমাকে বাদ দেওয়া হয়। যা আমার জন্য খুবই অপমানজনক।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার অবর্তমানে প্রগ্রামটির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সৈয়দ আবদুল হাদী ও অনুষ্ঠানটির গবেষক হিসেবে গীতিকবি মুন্সী আবদুল ওয়াদুদ দায়িত্ব পালন করছেন। আর অনুষ্ঠানটির প্রযোজক হিসেবে আছেন মাহবুবা জেমি।’
বিটিভির সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত শিল্পীদের অধিকার ও তাঁদের দাবি দাওয়ার পাশাপাশি বিটিভির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রায়ই জোরালোভাবে কথা বলেন শেখ সাদী খান। এ কারণে শেখ সাদী খানকে বিটিভির ওই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি থেকে আচমকা বাদ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা শেখ সাদী খান সবসময়ই একটু “ত্যাড়া” টাইপের মানুষ। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপোষ করেন না।’
এ বিষয়ে বিটিভির ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ অনুষ্ঠানের প্রযোজক মাহবুবা জেমিকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলব না। আপনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলুন।’
পরে এ নিয়ে বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) নূরুল আজম পবন ও মহাপরিচালক (ডিজি) মাহাবুব আলম গোরাকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তারা রিসিভ করেননি।
শেখ সাদী খানের অবর্তমানে ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ অনুষ্ঠানের বর্তমান সঙ্গীত পরিচালক কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদীর বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
এদিকে, শেখ সাদী খানের বিটিভি থেকে বাদ পড়ার খবরে তার জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ ফুঁসে উঠেছেন। ফেসবুকে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা।
শেখ সাদী খানের পৈত্রিক নিবাস নবীনগর উপজেলায় থাকা নবীনগর রিপোর্টার্স ক্লাব ও নবীনগরের কথার প্রায় ৪০ জন সাংবাদিক একযোগে তাঁদের স্ব স্ব ফেসবুকে শেখ সাদী খানের ছবি দিয়ে এ ঘটনার নিন্দা, উদ্বেগ জানিয়ে তাকে সম্মানের সঙ্গে বিটিভিতে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দ্য আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সাবেক সেক্রেটারি সৈয়দ আবদুল মান্নান সরকার, শহরের অংকুর স্টুডিওর স্বত্ত্বাধিকারী সঙ্গীতশিল্পী আনিছুল হক রিপন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদস্যসচিব সঞ্জীব ভট্টাচার্য, সাংবাদিক নেতা জহির রায়হান, শাহীন রেজা টিটুসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় উপমহাদেশের মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জী, হৈমন্তী শুক্লাসহ বাংলাদেশের রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী সৈয়দ আবদুল হাদির মতো কণ্ঠশিল্পীরা শেখ সাদী খানের সুরে অসংখ্য গান করেছেন।