রপ্তানি খাতের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি

বাংলাদেশ থেকে আমাদানিকৃত পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার মধ্যরাতে নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নীতির অংশ হিসাবে শুল্ক বৃদ্ধির এ ঘোষণা দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১০ ডলার মূল্যের একটি টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের শুল্ক (১৫ শতাংশ হারে) গুনতে হতো দেড় ডলার। এখন ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপে একই টি-শার্টে ৩ দশমিক ৭ ডলার শুল্ক গুনতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সেই টি-শার্টের দাম পড়বে ১৩ দশমিক ৭ ডলার। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতার চাহিদা কমে বাজার সংকুচিত হতে পারে। যার প্রভাবে দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

নতুন শুল্ক আরোপের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার। রোববার জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এ বৈঠক হওয়ার কথা। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যুর ইতিবাচক সমাধান হবে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। যেহেতু এটি আলোচনাযোগ্য, তাই আমরা আলোচনা করব এবং আমি নিশ্চিত যে আমরা সর্বোত্তম সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’ বৃহস্পতিবার ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অধ্যাপক ড. ইউনূসের বরাত দিয়ে এ কথা জানান। প্রেস সচিব বলেন, আমরা এমন কিছু করব যেন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, নতুন শুল্ক আরোপের প্রভাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। একই বাজারে চলতি অর্থবছরে ৬৯৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। নতুন শুল্ক আরোপের কারণে রপ্তানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে প্রতিযোগী কয়েকটি দেশের শুল্কহার বাংলাদেশের তুলনায় বেশি আরোপ করা হয়েছে। এতে কিছুটা সুবিধা আসতে পারবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ, রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞমহল মনে করছে, ট্রাম্প প্রশাসনের এ উদ্যোগে রপ্তানি খাতের ঝুঁকি বেশি, সুবিধা কম হবে।

অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকদের মতে, বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে বিদেশি ক্রেতারা শিগ্গিরই দেশীয় রপ্তানি পণ্যের দাম কমানোর চাপ দিতে পারে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রেতার চাহিদা হ্রাস পাবে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসার খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা হ্রাস, বিকল্প বাজার সন্ধানসহ ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে সংস্কার করে আঞ্চলিক বাজারের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপের বিষয়ে এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলতে পারব না। এ নিয়ে আমি স্টাডি করছি। পর্যালোচনা করে জানাতে পারব।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়ে ব্যাংককে শফিকুল আলম আরও বলেন, ‘এখনো পুরো বিষয়টি আলোচনা শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এটা পর্যালোচনা করছি এবং আমরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছি, তাতে আশাবাদী সামনের দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। আমরা এমন একটা সমাধানের দিকে যেতে পারব, যাতে উভয় পক্ষের জন্য উইন-উইন সিচুয়েশন হয়।’

এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যে আরোপিত শুল্ক পুনর্বিবেচনা করছে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দ্রুত সময়ের মধ্যে শুল্ক যুক্তিসঙ্গত করার বিকল্পগুলো চিহ্নিত করছে, যা বিষয়টি সমাধানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও লেখেন, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়াতে একযোগে কাজ করে আসছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে চলমান আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যু সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশের মধ্যে তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ৩০ শতাংশ, শ্রীলংকার ওপর ৪৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ ও কম্বোডিয়ার ওপর ৪৭ শতাংশ ও চীনের ওপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এখন ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ার শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হবে, সে কারণে তৈরি পোশাকশিল্প অতটা আক্রান্ত হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর আরোপিত শুল্ক আমাদের চেয়ে কম। এই ফাঁকে ভারত হয়তো লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তারা এমনিতেই কিনবে কম এর জেরে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিকেএমইর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে জানান, তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বাংলাদেশের উচিত, মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচলিত শুল্কের হার ৭৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা। এ উদ্যোগ নিলে তেমন সমস্যা হবে না। দ্বিতীয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় তুলা আমদানিকারক হচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করা দরকার তুলা ব্যবহার করে যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাবে সেগুলোর শুল্কহার যেন শিথিল করা হয়। তিনি আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণের আগে এমন ঘটনা গলায় ফাঁস দেওয়ার মতো। প্রসঙ্গত, বছরে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর মধ্যে পেট্রোলিয়াম গ্যাস আমদানির ওপর ১৩০ শতাংশ ডিউটি আছে। দ্বিতীয় আমদানি পণ্য আয়রন ও স্ক্র্যাপ সেটিতে শূন্য শুল্ক রয়েছে। তৃতীয় আমদানি পণ্য তুলায় শূন্য শুল্ক। 

সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর। যে কোনো বিচারেই এটি বড় মাত্রার আমদানি শুল্ক, যা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেবে। যেহেতু আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির ৯০ শতাংশ যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন সে দেশের ক্রেতারা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রপ্তানির ওপর। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন বলেছে তারা পালটা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্য কমে প্রভাব ফেলবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলে মার্কিন বাজার ছাড়াও অন্যান্য দেশের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, দ্বিপাক্ষিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা এনে তৈরি পোশাক উৎপাদন করে মার্কিন বাজারে রপ্তানি করার বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যেসব পণ্যে মার্কিন কাঁচামাল ব্যবহার হবে সেখানে শুল্কনীতি শিথিল রাখা হবে। এ সুযোগ নেওয়া যেতে পারে।

কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির সাবেক প্রধান এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক যুগান্তকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি কমবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে ভারত ও ভিয়েতনামে আমাদের তুলনায় কম। অপরদিকে চীনে অনেক বেশি। ফলে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। মোটা দাগে সব দেশের বাজার কমবে যুক্তরাষ্ট্রে। এতে ক্ষতিগ্রস্তও হবে দেশগুলো।

আবদুর রাজ্জাক মনে করেন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াতে পারে। যেটি বাংলাদেশ পারবে না। কারণ কারেন্সি অবমূল্যায়ন করলে দেশে আরও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

LEAVE A REPLY