ট্রাম্প কেন চীনের ওপর ক্ষুব্ধ, ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে?

হঠাৎ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ অনেকটা পরিষ্কারভাবে সামনে এসেছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে একযোগে লড়াইয়ের বদলে এখন এটি অনেক বেশি ‘আমেরিকা বনাম চীন’ বলে মনে হচ্ছে।

যদিও অনেক দেশের ওপর আরোপিত উচ্চ ‘প্রতিশোধমূলক’ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, তবুও সার্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক এখনো বলবৎ রয়েছে।

কিন্তু চীন; যেখান থেকে আইফোন থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনা পর্যন্ত সবকিছু আমদানি করা হয় এবং যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির প্রায় ১৪ শতাংশ যোগান দেয়, তাদের ওপর শুল্কের হার ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

ট্রাম্প বলেছেন, এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণ চীনের পক্ষ থেকে আমেরিকান পণ্যের ওপর ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ, যা তিনি ‘অসম্মানজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন।

এর আগে ট্রাম্প প্রথমবার হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন চীন-বিরোধী বার্তার ওপর ভিত্তি করে। এখানে শুধু প্রতিশোধ নয় বরং এর পেছনে রয়েছে আরো গভীর কিছু। ট্রাম্পের জন্য এটি হলো তার প্রথম মেয়াদের ‘অসমাপ্ত কাজ’ শেষ করার সুযোগ।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা তখন সঠিক কাজটি করার সময় পাইনি, যা এখন করছি।’ 

এর লক্ষ্য হলো চীনকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে আটকে দেওয়া এবং চীনকেন্দ্রিক বাণিজ্য ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। এটি বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে এমন এক সময়ে যখন কেউ ভাবেনি ট্রাম্প কখনো প্রেসিডেন্ট হবেন।

বিবিসির উত্তর আমেরিকার সিনিয়র সংবাদদাতা জন সাডওয়ার্থ বলেন, ২০১২ সালে যখন আমি প্রথমবার সাংহাইতে রিপোর্ট করতে যাই, তখন অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন যে চীনের সঙ্গে যু্ক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বৃদ্ধি একটি দারুণ পদক্ষেপ।এটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছিল, সস্তা পণ্যের জোগান দিচ্ছিল, চীনের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শক্তিশালী করছিল এবং বহুজাতিক কম্পানিগুলোর জন্য চমৎকার লাভজনক সুযোগ তৈরি করছিল।

পরবর্তীতে কয়েক বছরের মধ্যেই চীন হয়ে ওঠে রোলস রয়েস, জেনারেল মোটরস এবং ভক্সওয়াগনের সবচেয়ে বড় বাজার।

তখন ধারণা ছিল, ধনী হলে চীনের জনগণ রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তুলবে এবং দেশটি রপ্তানি নির্ভরতা ছেড়ে উপভোক্তা সমাজে রূপান্তরিত হবে।

কিন্তু প্রথম ধারণাটি বাস্তবায়িত হয়নি – বরং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আরো শক্তভাবে ক্ষমতা দখল করেছে।

আর দ্বিতীয় রূপান্তর ঘটলেও ধীরে – চীন এখনো রপ্তানিনির্ভর এবং তাদের ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতির মাধ্যমে আরো আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করছে।

এরপরের বছরেই এক রাজনৈতিক নবাগত ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন এবং বারবার অভিযোগ করেন যে চীনের উত্থান আমেরিকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, শিল্প এলাকা শূন্য করেছে এবং ব্লু-কলার শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নিয়েছে।

তার প্রথম মেয়াদের বাণিজ্য যুদ্ধ প্রচলিত নীতিকে ভেঙে দিয়েছিল এবং তার উত্তরসূরি জো বাইডেনও সেই শুল্কের অনেকগুলো বজায় রেখেছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, এসব শুল্ক চীনের অর্থনৈতিক মডেল পরিবর্তনে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।

আর এসব কারণেই চীন আজ বিশ্বব্যাপী ৬০ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ৮০ শতাংশ ব্যাটারি উৎপাদন করে যা অধিকাংশই নিজেদের কম্পানির মাধ্যমে।

এসব কারণে ট্রাম্প এখন আবার ফিরে এসেছেন পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের নতুন এক রাউন্ড নিয়ে। এই পদক্ষেপ হয়তো বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা হতে পারত, যদি না এর আগে নানা রকম শুল্ক ও প্রতিশুল্কের ঘটনাগুলো ঘটত।

তবে এরপর কী হবে, তা নির্ভর করছে দুটি বড় প্রশ্নের ওপর। প্রথমত, চীন কি আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করবে? দ্বিতীয়ত, যদি করে; তবে চীন কি এমন ধরনের ছাড় দিতে রাজি হবে যা আমেরিকা চাইছে— যেমন সম্পূর্ণ রপ্তানি নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়, কারণ আমরা সম্পূর্ণ অজানা পথে হাঁটছি – কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে কিছু সতর্কতামূলক বিষয় রয়েছে।

চীনের অর্থনৈতিক শক্তির ধারণা – যা শক্তিশালী রপ্তানি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার রক্ষার ওপর নির্ভর করে। তাদের তথ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকায় তারা সহজে মার্কিন প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর জন্য বাজার খুলবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু আরেকটি তৃতীয় প্রশ্নও আছে এবং সেটি আমেরিকার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করে? ট্রাম্প প্রায়ই বলেন, শুল্ক ভালো— শুধু একটি উপায় হিসেবে নয়, বরং উদ্দেশ্য হিসেবেও।

তিনি বলেন, এই ধরনের সুরক্ষামূলক বাধা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়াবে, আমেরিকান কম্পানিগুলোকে দেশেই উৎপাদনে উৎসাহিত করবে এবং কর রাজস্ব বাড়াবে।

আর বেইজিং যদি মনে করে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য, তাহলে হয়তো আলোচনার কিছু নেই বলেই ধরে নেবে। তাহলে দুই বৃহৎ পরাশক্তি অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরিবর্তে মুখোমুখি হতে পারে ‘জয়ী নয়তো সব হারানোর’ প্রতিযোগিতায়।

এমনটা হলে, সত্যিই পুরনো বাণিজ্যিক ধ্যান-ধারণার অবসান ঘটবে এবং সামনে অপেক্ষা করবে এক ভিন্ন, সম্ভবত অনেক বেশি বিপজ্জনক ভবিষ্যৎ।

LEAVE A REPLY