গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা টঙ্গী। এই এলাকার ১৯টি বস্তিতে ছয় লাখেরও বেশি শ্রমজীবী মানুষের বাস। এসব মানুষের ভিড়ে বস্তিতে ঘাঁটি গেড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পেশাদার অপরাধীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে বিভিন্ন বস্তির তিন শতাধিক খুপরি ঘরকে ‘নিজেদের সেকেন্ড হোম’ হিসাবে গড়ে তুলেছে। ঘরের ভেতর রয়েছে গোপন সুড়ঙ্গ। অপরাধ সংঘটনের পর যে পথ ধরে অপরাধীরা নিরাপদে পালাতে পারে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ ঘটিয়ে অপরাধীরা আত্মগোপন করে টঙ্গীর বস্তিতে। এই বস্তিগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যসহ প্রায় তিন হাজার সশস্ত্র ক্যাডার সক্রিয় রয়েছে। এরা খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিভিন্ন লোমহর্ষক অপরাধে ভাড়ায় খাটে। এসব সশস্ত্র ক্যাডারদের লালনপালন ও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই অপরাধীরাই মূলত উত্তপ্ত করছে টঙ্গীর অপরাধ জগত। সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। টঙ্গীর ব্যাংক মাঠ বস্তির বাসিন্দা আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে টঙ্গীতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতির। তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল টঙ্গীর ১৯ বস্তি ও টঙ্গী এলাকার অপরাধ কর্মকাণ্ড। মতি চাচার অনুসারীরা বস্তির উঠতি কিশোর-তরুণদের দলে ভিড়িয়ে দুর্ধর্ষ করে তুলেছে। তাদের দিয়ে ঘটায় বিভিন্ন অপরাধ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর টঙ্গীর ডন মতিউর রহমান মতি আত্মগোপনে থেকে অনুসারীদের দিয়ে এখনো টঙ্গীর অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। পটপরিবর্তনের পর থেকে শীর্ষ ক্যাডারদের অনেকেই ইউটার্ন করে বর্তমান নিয়ন্ত্রকদের অধীনে চলে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টঙ্গীর বস্তিতে বসবাসরতদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। ভাসমান এসব মানুষের মধ্যে চুরি, ছিনতাই, মাদক, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠায় অন্তত ২০ শতাংশ লোক জড়িয়ে গেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বস্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই ক্যাডার গ্রুপ। টঙ্গী রেল স্টেশনের পাশের কেরানিরটেক বস্তিতে রয়েছে ৪৫০ জন, এরশাদ নগর বাস্তুহারায় ৯০০, হাজির মাজার বস্তিতে ৫১০, ব্যাংক মাঠ বস্তিতে ২০০, নামাবাজার মিলগেট বস্তিতে ১২০ জন, বউবাজার রেললাইন বস্তি এলাকায় ১১০, মরকুন বস্তি এলাকায় ৬০ জন সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। এছাড়া অন্য বস্তির প্রতিটিতে গড়ে ৫০-৬০ জন করে শসস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। তাদের অধিকাংশই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা বস্তিগুলোতে রাজত্ব করছে।
সেকেন্ড হোম : টঙ্গী পশ্চিম থানার হাজি মাজার বস্তি। এই বস্তির ভেতরে সম্প্রতি অপরাধীদের এক অভিনব দুর্গের সন্ধান মেলে। এতে পাওয়া যায় মাদক পাচারের গোপন নেটওয়ার্কও। এসব দুর্গের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা যেন অপরাধীদের সেফ জোন। এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, এই বস্তি টঙ্গীর অপরাধ সাম্রাজ্যের চোরাগলি। মাজার বস্তিতে নেপথ্য থেকে অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে রবিউল ইসলাম ওরফে কিং বাবু, সিদ্দিকুর রহমান ডুবলি ও শাহাবুদ্দিন দাবারু। কিং বাবুর বাড়িতেই ১২০টির মতো সেকেন্ড হোম রয়েছে। এছাড়া সিদ্দিকুর রহমান ডুবলির ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে আড়াইশর বেশি সেকেন্ড হোম। এগুলোর কোনো কোনোটিতে গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে। ইতঃপূর্বে কিং বাবুর ডেরায় অভিযান চালিয়ে সেকেন্ড হোমের সন্ধান পায় যৌথ বাহিনী। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় ৪৩ অপরাধীকে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে কিং বাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার আস্তানা হাজি মাজার বস্তিতে গিয়েও তার হদিস পাওয়া যায়নি। হাজি মাজার বস্তির একাধিক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর কিং বাবু আত্মগোপনে চলে গেছেন। বস্তির ভেতরে বিএনপি ইউনিট অফিসের সামনে কথা হয় সিদ্দিকুর রহমান ডুবলি ও শাহাবুদ্দিন দাবারুর সঙ্গে। বস্তির মাদক ব্যবসা এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডুবলি বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের লোকজন বস্তি চুষে খেয়েছে। তাদের তাড়িয়েছি। এখন আমাদের খাওয়ার পালা। শাহাবুদ্দিন দাবারু বলেন, এসব বিষয় নিয়ে বিরক্ত করবেন না। আরও অনেক কাজ আছে সেগুলো গিয়ে আপনারা করেন।’
হাজি মাজার বস্তির এক নারী বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, কয়েক মাস আগে একলোক একটি রুম বিক্রি করে চলে যান। ওই রুমটি যিনি কিনেছেন তাকে কোনোদিন দেখা যায়নি। মিস্ত্রিদের এসে কাজ করতে দেখেছি। ভেতরে বিভিন্ন আসবাবপত্রও মিস্ত্রিদের মাধ্যমেই আনা হয়। অনুসন্ধানে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘরের সন্ধান মেলে। ঘরের ভেতরে অবিশ্বাস্য দৃশ্য। প্রতিটি ঘরে রয়েছে সুপরিকল্পিত সুড়ঙ্গ। একদিক দিয়ে প্রবেশ আর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। এমনকি কেউ পালিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে দরজা ভেতর থেকে লক হয়ে যায়।
টঙ্গীর সবচেয়ে বড় বস্তি এরশাদ নগর বাস্তুহারায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে শুধু খুপরি ঘর নয়, বিভিন্ন পাকা ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে অনেক অপরাধী। এই বস্তিতে ১৫০-এর অধিক সেকেন্ড হোম রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই পাকা ঘর। এই এলাকায় বসবাসরত অপরাধীদের শেল্টার দিচ্ছে বস্তির স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার আশ্রয়-প্রশ্রয়েরও অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বস্তির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী টিভি আনোয়ার যুগান্তরকে বলেন, আমি এখানে ব্যবসা করি। আমার পরিবার অন্যত্র থাকে। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। আরেক প্রভাবশালী কামরুল ইসলাম কামু এরশাদ নগর বস্তির অপরাধ জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়েও বসবাস করছে অপরাধীরা।
এদিকে কেরানিরটেক বস্তির অলিগলিতে দিন-রাত সন্ত্রাসীরা পালা করে বাইরে পাহারা দেয়। এতে করে নিরাপদে ব্যবসা চালাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আর ভেতরে ঘরভাড়া নিয়ে বসবাস করেন বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত অপরাধীরা। মাদকসম্রাজ্ঞী রানীর মা বেবির শেল্টারে বস্তিতে অপরাধীদের ঘর ভাড়া দিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন। এই বস্তিতে অন্তত ৩০ জন অপরাধী সেকেন্ড হোম হিসাবে ঘর ভাড়া নিয়ে গোপনে বসবাস করে আসছেন। বক্তব্য নিতে কেরানিরটেক বস্তিতে এবং দত্তপাড়া এলাকায় গিয়েও রানী কিংবা তার মা বেবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ব্যাংক মাঠ বস্তিতে গিয়ে জানা গেছে, এখানে আওয়ামী লীগ নেত্রী ময়নার অধীনেও ১০টির বেশি সেকেন্ড হোম রয়েছে। সম্প্রতি ময়না গ্রেফতার হয়েছে।
শুধু এসব বস্তিই নয়, ১৭ বস্তির প্রতিটিতেই শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি মাদকের পাইকারি ক্রেতা ও বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত অপরাধীরা সেকেন্ড হোম হিসাবে ভাড়া নিচ্ছে। বস্তির বিভিন্ন খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে এদের কেউ কেউ বছরের পর বছর নিরাপদে অবস্থান করছেন। এসব অপরাধীদের কেউ পেশাদার ডাকাত, কেউ ছিনতাইকারী, কেউ অন্য কোনো মামলায় দাগি অপরাধী। তারা ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ সংঘটিত করে বস্তির এসব ঘরে এসে আশ্রয় নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টঙ্গী এলাকার একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে বস্তিবাসীর ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর। এই কারণে কোনো রাজনৈতিক নেতা বস্তির অপরাধ নিয়ে মাথা ঘামান না। আবার কোনো কোনো নেতা বস্তির অপরাধীদের সময়-সুযোগমতো নিজেদের কাজে লাগান। মিটিং-মিছিলে লোক সংগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে বস্তির এসব ক্যাডাররাই কাজে লাগে।
টঙ্গীর কলাবাগান বস্তির বাসিন্দা আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গীর দুই থানার বস্তি এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের একটা বড় অংশ নানা কারণে বিভিন্ন অপরাধ এবং নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। এই অপরাধীরা এতটাই ভয়ংকর যে, তাদের ভয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এমনকি পুলিশও রাতে বস্তি এলাকায় ঢোকার সাহস পায় না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকার আসে যায়, টঙ্গীর অপরাধ জগত বন্ধ হয় না। স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন বলেন, চাঁদপুরের আলোচিত সিরিয়াল কিলার রসু খা এই বস্তিতে থেকেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড করে আসে। তাছাড়া বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধী সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন টঙ্গী এলাকা থেকে।
টঙ্গী এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন শামীম হোসেন। থাকতেন কেরানিরটেক বস্তিতে। বস্তির একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নজর পড়ে তার ওপর। ওই দলের নেতা রনি গত বছর তাকে ডেকে তার গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়। শামীম তাকে কৌশলে এড়িয়ে যান। এরপর থেকে শামীমকে ভয়ভীতি দেখানো শুরু হয়। এরপর শামীম এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। শামীম যুগান্তরকে বলেন, রনি হলো মাদকসম্রাজ্ঞী রানীর ভাই। সে এলাকার ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সে কাউকে টার্গেট করলে তার হাত থেকে বাঁচা বড়ই কঠিন। এ বিষয়ে চেষ্টা করেও রনির সঙ্গে কথা বলা যায়নি। পুলিশের খাতায় অপরাধী রনি প্রকাশ্যে আসছে না। ২৯ আগস্ট সেলিম নামে এক যুবককে নৃশংসভাবে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এই রনি।
একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত অপরাধী এবং চাঞ্চল্যকর মামলার দাগি আসামিরা টঙ্গী এলাকায় এসে বস্তির খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে এক ধরনের আত্মগোপনে থাকে। আবার মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক সেবনকারীদেরও কেউ কেউ বস্তিতে ঘর ভাড়া নেয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি অপরাধ দক্ষিণ) এনএম নাসিরুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গী মূলত অপরাধপ্রবণ এলাকা। এখানে মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী এবং ভাসমান অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। আমরা প্রতিনিয়তই অভিযান করছি। অভিযানে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে।